Logo
Logo
×

প্রযুক্তি

সবার জন্য প্রযুক্তি, সবার জন্য রূপান্তর

Icon

আইটি ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ মে ২০২৫, ১৬:৫৭

সবার জন্য প্রযুক্তি, সবার জন্য রূপান্তর

নতুন শতাব্দীর সূচনায় প্রযুক্তি ও মানবিকতার মেলবন্ধনে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে উঠছে—যেখানে কেউ পেছনে পড়ে থাকবে না, কেউ বাদ যাবে না। এই স্বপ্নের বাস্তব রূপ দিতেই ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণের যাত্রা শুরু হয়েছিল। আর এখন, সেই যাত্রা আরও একধাপ এগিয়ে পৌঁছেছে রূপান্তরের দশকভিত্তিক কল্পনায়। এই কল্পনা কেবল প্রযুক্তির উন্নয়ন নয়, বরং তা মানুষের জীবনের পরিপূর্ণতায় প্রযুক্তির সেবাকে পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন। যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন এবং টেকসই সামাজিক অগ্রগতি।

বাংলাদেশে ই-গভর্নেন্স কেবল প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনার নাম নয়। এটি একটি রাষ্ট্রচিন্তার রূপান্তর, যেখানে সেবাপ্রাপ্তির ন্যায্যতা নিশ্চিত হয় ডিজিটাল মাধ্যমে। এ প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধী এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) যেভাবে বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের কথা বলে, বাংলাদেশ সরকার সেই নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রযুক্তিনির্ভর একটি মানবিক রাষ্ট্র গড়তে অঙ্গীকারবদ্ধ। এই অঙ্গীকারকে বাস্তবতা দিতে চালু হয়েছে অ্যাক্সেসিবল ডিকশনারি, মাল্টিমিডিয়া টকিং বুক, ডিজঅ্যাবিলিটি ইনোভেশন ল্যাব, এবং বিশেষ ডিজিটাল সেবা কেন্দ্র।

প্রযুক্তির এ ব্যবস্থার সুবিধা বাস্তবে কীভাবে মানুষকে উপকারে আনছে তা বোঝা যায় কিছু জীবন্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার কৃষক আবদুল করিমের জীবনেও প্রযুক্তি এনেছে নতুন সম্ভাবনা। আগে প্রতি মওসুমে তাকে কৃষি অফিসে গিয়ে নানা কাগজপত্র জমা দিয়ে প্রণোদনার জন্য আবেদন করতে হতো। দপ্তরের ভিড়, কাগজপত্রের গোলমাল, কখনো আবার কর্মকর্তার অনুপস্থিতি—এসব সামলাতে গিয়ে তার বহু সময় আর খরচ হতো। এখন তিনি ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে গিয়ে সহজেই অনলাইনে কৃষি প্রণোদনার আবেদন জমা দেন। মোবাইলে নোটিফিকেশন পেয়ে জানতেও পারেন কবে কোথায় কী আপডেইট হচ্ছে। এক টাকাও বাড়তি খরচ না করে, দালাল ছাড়া, নিজের ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা পেয়ে যান সময়মতো।

এভাবেই, কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার শিক্ষার্থী রেহানার গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয় ডিজিটাল সেবার আরেক মানবিক দিক। উচ্চ মাধ্যমিক ফরম পূরণের সময় রেহানা দেখতে পান—নিজের নামের বানানে স্কুলের নথিতে একটি ভুল আছে। আগে এমন ভুল ঠিক করাতে হলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ডে গিয়ে ঘুরাঘুরি করতে হতো, দিনের পর দিন সময় দিতে হতো। কিন্তু এখন, ডিজিটাল শিক্ষাসেবা প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে রেহানার স্কুল থেকেই অনলাইন আপডেইট করা হয় এবং কয়েক দিনের মধ্যে সংশোধিত নথি হাতে পান তিনি। এই সময়মত সেবা রেহানার পড়ালেখার স্বপ্নকে ভেঙে পড়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে দেয়।

এসব উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, প্রযুক্তি ব্যবহারে দারিদ্র্য ও অক্ষমতা আর বাধা নয়—বরং এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার। বাংলাদেশের ই-গভর্নেন্স প্রক্রিয়া এই মর্মেই এগিয়ে যাচ্ছে, যেখানে ডিজিটাল প্রযুক্তির সুবিধা পৌঁছে যাচ্ছে সবার দোরগোড়ায়। এ যেন কেবল উন্নয়ন নয়, একধরনের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা—যেখানে সকল নাগরিক রাষ্ট্রের সেবার সমান অংশীদার।

এই পুরো প্রক্রিয়ায় একটি বড় পরিবর্তন এসেছে পরিমাপক ব্যবস্থায়। এসডিজির অগ্রগতির পরিমাপে চালু করা হয়েছে ‘এসডিজি ট্র্যাকার’, যেখানে দেশের সব তথ্য দৃশ্যমান করা হচ্ছে। এতে করে সরকার, গবেষক এবং নাগরিকেরা জানতে পারছেন উন্নয়নের গতিপথ কোন দিকে যাচ্ছে, কোন জায়গায় উন্নতি হয়েছে আর কোন জায়গায় এখনো কাজ করার প্রয়োজন রয়েছে। এটুআই- এর সহায়তায় এই ট্র্যাকার তৈরি ও ব্যবহার আজ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও প্রশংসিত হয়েছে।

তবে এ সাফল্যের পাশে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো ডিজিটাল বৈষম্য। যতক্ষণ না পর্যন্ত দেশের প্রতিটি নাগরিক ইন্টারনেট এবং ডিজিটাল সেবায় অভিগম্যতা পাচ্ছেন, ততক্ষণ রূপান্তরের স্বপ্ন পূর্ণতা পাবে না। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু প্রকৃত সংখ্যাটি এখনও অনেক কম। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, প্রতি ১০০ জনের মধ্যে মাত্র ৩৯ জন ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার গড় হলো ৪২ শতাংশ এবং নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলোর গড় হলো ৫৬ শতাংশ।

এই বৈষম্য কাটিয়ে ওঠার জন্য চাই উদ্ভাবনী কর্মপরিকল্পনা। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর শ্লোগান তখনই অর্থবহ হবে, যখন ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা যাবে। এজন্যই সরকার বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে ‘ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন’ এবং ‘এজেন্ট ব্যাংকিং’ কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে। ডিজিটাল সেন্টারগুলোতে চালু করা হয়েছে প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা সেবা ডেস্ক।

প্রযুক্তিনির্ভর এই সমাজে প্রতিবন্ধী নাগরিকদের জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা টুলস যেমন অ্যাক্সেসিবল ডিকশনারি বা টকিং বুক কেবল শিক্ষা নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁদের সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। একইসঙ্গে ‘ডিজঅ্যাবিলিটি ইনোভেশন ল্যাব’ উদ্ভাবনী কাজের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছে। এসব উদ্যোগ এক নতুন বাংলাদেশ গঠনের রূপরেখা আঁকছে, যেখানে প্রতিটি মানুষের সম্ভাবনা মূল্যায়িত হয়।

এসডিজি বাস্তবায়নে স্থানীয়করণের গুরুত্ব অপরিসীম। এ কারণে বাংলাদেশ সরকার ২০১৭ সালে উপজেলাভিত্তিক এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য ‘৩৯+১’ মডেল গ্রহণ করেছে, যেটি এখন ‘বাংলাদেশ মডেল’ হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত। এই মডেল অনুযায়ী, জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে উন্নয়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা ও পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

এটি কেবল প্রশাসনিক নয়, বরং একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, যেখানে সাধারণ নাগরিক, জনপ্রতিনিধি, সেবা প্রদানকারী এবং নীতিনির্ধারক সবাই মিলে রূপান্তরের অংশীদার। ট্র্যাকারভিত্তিক উন্নয়ন চিন্তায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হচ্ছে, যা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করছে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রেক্ষাপটে এই রূপান্তরের দশকভিত্তিক পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে সাহসী এক প্রচেষ্টা। তবে এটি সফল করতে হলে ডিজিটাল বিভাজনকে দূর করা, সবার জন্য সহজ ও সাশ্রয়ী ইন্টারনেট নিশ্চিত করা এবং নীতিনির্ধারকদের কাছে সব সময় প্রান্তিক মানুষের চাহিদা তুলে ধরা জরুরি। উন্নয়ন তখনই টেকসই হবে, যখন তা হবে সবার জন্য।

এই রূপান্তরের অভিযাত্রায় বাংলাদেশের পদক্ষেপগুলো ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। এখন সময় এসেছে এই যাত্রাকে আরও গতিশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানবিক করে গড়ে তোলার। প্রযুক্তি হবে তখনই সত্যিকারের উন্নয়নের বাহন, যদি সেটি প্রতিটি মানুষের জীবনে সমানভাবে কাজে লাগে। তাই এই রূপান্তরের দশক হোক সমতার, মানবতার এবং প্রগতির এক অনন্য উদাহরণ।



Logo

অনুসরণ করুন