Logo
Logo
×

প্রযুক্তি

বাংলাদেশে ই-গভর্নেন্সের বহুমাত্রিক পথচলা

Icon

আইটি ডেস্ক

প্রকাশ: ১৪ মে ২০২৫, ১৭:৫০

বাংলাদেশে ই-গভর্নেন্সের বহুমাত্রিক পথচলা

তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ নির্মাণের যে বৈশ্বিক যাত্রা ২০০১ সালে জাতিসংঘের ডব্লিউএসআইএস উদ্যোগের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশ সেখানে শুরু থেকেই নিজেকে সক্রিয়ভাবে যুক্ত করে। তখনো দেশের অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি, মোবাইল ফোন সাধারণের হাতে আসেনি, কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রযুক্তিকে যুক্ত করার যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা, সেটির প্রকাশ ঘটে ২০০২ সালে যখন বাংলাদেশ সরকার জাতীয় আইসিটি নীতিমালা প্রণয়ন করে। এরপর ২০০৩-২০০৬ সময়কালে আইসিটি টাস্কফোর্স ও এসআইসিটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়—যা দেশের তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর রাষ্ট্র গঠনের প্রাথমিক ভিত্তি নির্মাণ করে দেয়।

এই টাস্কফোর্স ও এসআইসিটি প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো সরকার প্রমাণ করে, তারা প্রশাসনকে দক্ষ করতে এবং নাগরিক সেবাকে সহজ করতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে আগ্রহী। শিক্ষা, কৃষি, ভূমি, পশুপালন, সচিবালয়সহ নানা দপ্তরে একের পর এক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারকরণ শীর্ষক প্রকল্প চালু হয়। এর মধ্যে অনলাইন রেজাল্ট, ভূমি রেকর্ড ডিজিটালাইজেশন, বাজার তথ্য ব্যবস্থাপনা কিংবা ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মতো কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছিল। তবে এই উদ্যোগগুলো তখনো তথ্যপ্রযুক্তি ভিত্তিক সেবাদানের পুরো অবয়ব দিতে পারেনি। অর্থাৎ, একটি পূর্ণাঙ্গ রূপান্তরের কাঠামো তখনও দৃশ্যমান হয়নি।

এই ঘাটতি পূরণের জন্যই ২০০৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ‘একসেস টু ইনফরমেশন’ বা এটুআই প্রোগ্রামের যাত্রা শুরু। এটিই ছিল সরকারি সেবার ডিজিটাল রূপান্তরের নতুন যাত্রাপথ, যা ভবিষ্যতের ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণে মূল চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। এটুআই শুধু তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করেনি, বরং একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনার মধ্য দিয়ে সরকারি ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা, স্বচ্ছতা এবং জনবান্ধবতা আনার প্রয়াস চালায়। একই সঙ্গে এটুআই প্রোগ্রাম আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর উদ্যোগ নেয়। মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরের মতো দেশ থেকে সরাসরি শেখার জন্য প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সেরা কাজগুলোর সঙ্গে নিজেদের পরিকল্পনা মিলিয়ে নেয়।

এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তৈরি হয় ‘ই-গভর্নমেন্ট প্ল্যান অব অ্যাকশন।’ পরিকল্পনায় ই-গভর্নমেন্ট সেল গঠন, দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য কার্যক্রমের তালিকা তৈরি ও কারিগরি সহায়তা প্রোগ্রাম চালুর সুপারিশ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৭-২০০৮ সালে একটি ই-গভর্নেন্স সেল গঠন করা হয় এবং এটুআই প্রোগ্রাম আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। এখান থেকেই শুরু হয় একটি কাঠামোবদ্ধ ডিজিটাল রূপান্তর যাত্রা, যার প্রভাব ক্রমে প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়ে।

ধাপে ধাপে চালু হয় ইউনিয়ন পরিষদভিত্তিক কমিউনিটি ই-সেন্টার পাইলট প্রকল্পের। সিরাজগঞ্জ ও দিনাজপুরের দুটি ইউনিয়নে শুরু হওয়া এই কার্যক্রম দেখে বোঝা যায়, ইউনিয়ন পরিষদই হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর সেবা কেন্দ্র। এখান থেকেই জন্ম নেয় ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্রের ধারণা। ২০১০ সালে দেশের সাড়ে চার হাজার ইউনিয়নকে এই উদ্যোগের আওতায় আনা হয়। পরবর্তীতে পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনে একই মডেল সম্প্রসারিত হয় এবং একে নাম দেওয়া হয় ‘ডিজিটাল সেন্টার’।

এই ধারাবাহিকতায় জেলা প্রশাসকের অফিসেও ই-সেবা কেন্দ্র চালু হয়। প্রথমে যশোরে শুরু হলেও পরে তা ৬৪ জেলাতেই সম্প্রসারিত হয়। এই সব কেন্দ্র প্রযুক্তিভিত্তিক সেবা দেওয়ার মাধ্যমে নাগরিকদের সময় ও খরচ বাঁচাতে শুরু করে। তবে শুধু শারীরিকভাবে উপস্থিত হয়ে নয়, নাগরিকরা যেন অনলাইনেও এ সব সেবা পান, সেই লক্ষ্যেই তৈরি হয় ওয়েবসাইট-ভিত্তিক সেবা প্ল্যাটফর্ম। জেলা পর্যায়ে তৈরি হয় জেলা তথ্য বাতায়ন এবং পরে তা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরভিত্তিক বিস্তৃত হয়ে ২০১৪ সালে রূপ নেয় জাতীয় তথ্য বাতায়নে।

তবে প্রযুক্তির এই ব্যবহারে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, প্রান্তিক মানুষের অন্তর্ভুক্তি। অনেকেরই ছিল না স্মার্টফোন, অনেকে ওয়েবসাইট ব্যবহার করতে জানতেন না। এ জন্য ২০১০ সালে বাংলা ভাষায় ফোনের ব্যবহার প্রচলনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এতে করে বাটন ফোন ব্যবহারকারীরাও ধীরে ধীরে ডিজিটাল সেবায় যুক্ত হতে থাকেন। কিন্তু সবার জন্য এই পথ সুগম করতে ২০১৮ সালে চালু হয় জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩, যেখানে ফোন করলেই নাগরিকরা সরকারি সেবা ও তথ্য পেতে পারেন। একই সময়ে জরুরি সেবার জন্য চালু হয় ৯৯৯, যা পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস এবং অ্যাম্বুলেন্স সেবা সহজ করে তোলে।

এই পুরো যাত্রার প্রতিটি ধাপে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা বলে দেয়, রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছা ও পরিকল্পনার সমন্বয়ে প্রযুক্তি ব্যবহার করলে একটি উন্নয়নশীল দেশ কীভাবে জনগণের কাছে রাষ্ট্রকে আরও কাছে নিয়ে আসতে পারে। ডিজিটাল রূপান্তর এখন আর কেবল একাডেমিক আলোচনা নয়, এটি সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকার অঙ্গ। প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন কৃষক, গার্মেন্টস কর্মী কিংবা প্রবাসী বাংলাদেশি, সবাই এখন এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সরাসরি যুক্ত হতে পারছেন রাষ্ট্রীয় সেবার সঙ্গে।

‘রূপান্তরের অনুঘটক’ হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তি কেবল একটি যন্ত্রগত পরিবর্তন নয়, এটি রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্কের রূপান্তর। ভবিষ্যতে এই সম্পর্ক আরও জোরালো হবে, যদি প্রযুক্তির এই প্রবাহে কাউকে পেছনে ফেলে না রাখা হয়। সকল নাগরিকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই ডিজিটাল বাংলাদেশ হবে প্রকৃত অর্থে অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই।


Logo

অনুসরণ করুন