Logo
Logo
×

প্রযুক্তি

প্রযুক্তির হাত ধরে ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রে পৌঁছাবে বাংলাদেশ?

Icon

আইটি ডেস্ক

প্রকাশ: ১৪ মে ২০২৫, ১৭:৪২

প্রযুক্তির হাত ধরে ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রে পৌঁছাবে বাংলাদেশ?

বিগত দশকে বাংলাদেশ অভূতপূর্বভাবে একটি তথ্যপ্রযুক্তি ভিত্তিক রাষ্ট্রে রূপান্তরের পথে এগিয়ে গেছে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, স্থানীয় সরকার, বেসরকারি খাত এবং উন্নয়ন সহযোগীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি হয়েছে, যা সেবাপ্রাপ্তি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—এই রূপান্তর কতটা মানবিক? কতটা অন্তর্ভুক্তিমূলক? আর এই প্রযুক্তি-নির্ভর রূপান্তর কি সত্যিই একটি ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রের ভিত্তি গড়ে দিচ্ছে?

আমরা যদি এই পরিবর্তনকে শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বা অবকাঠামোগত উন্নয়ন হিসেবে দেখি, তবে এ এক প্রকার সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি হবে। ডিজিটাল গভর্ন্যান্স বা স্মার্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন শুধু ই-ফাইলিং, ওয়ানস্টপ সার্ভিস বা ডিজিটাল পেমেন্টে সীমাবদ্ধ নয়—এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা, বিশেষ করে তাদের জন্য, যারা সমাজে পিছিয়ে পড়া, অবহেলিত ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে।


ব্যক্তির ক্ষমতায়নের নতুন অধ্যায়

এই রূপান্তরের সবচেয়ে শক্তিশালী দিকটি হলো—এটি সমাজের সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষটির হাতেও প্রযুক্তির মাধ্যমে সুযোগ পৌঁছে দিতে পেরেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় বরিশালের হিজলা উপজেলার ইমরান হোসেনের কথা। একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষ, যিনি দীর্ঘদিন ধরে মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহারে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছিলেন। ইমরান যখন ‘ডিজিটাল অ্যাক্সেসিবিলিটি’ নিয়ে অভিযোগ করেন, তখন বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়। মোবাইল ব্যাংকিং প্ল্যাটফর্মগুলোতে ভয়েস-ভিত্তিক নির্দেশনা ও স্ক্রিনরিডার ফিচার সংযুক্ত করা হয়, যা শুধু ইমরানের জন্য নয়, সারা দেশের প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য ডিজিটাল সেবাকে সহজলভ্য করে তোলে।

এটি নিছক একটি নীতিগত সংশোধন নয়—এটি একজন নাগরিকের অধিকার আদায়ের কাহিনি। ডিজিটাল গভর্ন্যান্স এখানে ‘টপ-ডাউন’ কোনো নির্দেশ নয়, বরং জনগণের চাহিদার প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নেওয়া ‘বটম-আপ’ পরিবর্তনের বাস্তবতা।

একইভাবে, পাবনার চাটমোহরের বিধবা নারী জমিলা খাতুন এখন আর ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেন না। স্থানীয় ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে তিনি ঘরে বসেই সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা গ্রহণ, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ, এমনকি আইনি পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন। এটি কেবল প্রযুক্তির ব্যবহার নয়, বরং এক ধরনের ক্ষমতায়ন—যা একজন নারীকে দালালনির্ভরতা থেকে মুক্ত করে আত্মমর্যাদার পথে নিয়ে গেছে।


উদ্ভাবনের মানবিক প্রতিচ্ছবি

বাংলাদেশ সরকারের আইসিটি বিভাগ, এটুআই, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ নানা সংস্থার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ডিজিটাল পোর্টালসমূহ, যেমন জাতীয় তথ্য বাতায়ন, সেবাদানকারী হেল্পলাইন (৩৩৩), মায়ের ডাক, কৃষি কল সেন্টার ইত্যাদি বাস্তবিক অর্থেই মানুষকে তথ্য-ভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করেছে।

কিন্তু এসবের চেয়েও বড় ব্যাপার হলো—প্রযুক্তি যেন এখন আর ‘অচেনা’ কোনো বস্তু নয়; বরং তা মানুষের জীবনযাপনের অংশ হয়ে উঠেছে। শিক্ষার্থী, কৃষক, গার্মেন্ট কর্মী, প্রতিবন্ধী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য—সবাই এখন কোনও না কোনওভাবে এই ডিজিটাল কাঠামোর অংশ। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উপযোগী ভাষা, আঞ্চলিক ভাষায় তথ্য উপস্থাপন এবং মাল্টিমিডিয়া টুল ব্যবহারের ফলে সেবাগ্রহণ এখন অধিকতর অংশগ্রহণমূলক হয়ে উঠেছে।

এক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী উদাহরণ হলো—‘মাল্টিমিডিয়া টকিং বুক’ বা ‘অ্যাক্সেসিবল ডিকশনারি’-এর মতো ডিজিটাল শিক্ষাসামগ্রী। এগুলোর মাধ্যমে শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরাও এখন মূলধারার শিক্ষায় প্রবেশ করতে পারছে। শুধু শিক্ষায় নয়, এ ধরনের প্রযুক্তি-নির্ভর সহায়ক সেবা একটি সমাজের সভ্যতা, মানবিকতা এবং ন্যায়বোধের পরিমাপ হিসেবেও কাজ করে।


এসডিজি ট্র্যাকার ও স্থানীয়করণ

ডিজিটাল গভর্ন্যান্সের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো—তথ্য-ভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সহযোগিতায় তৈরি ‘এসডিজি ট্র্যাকার’ এখন বিভিন্ন উন্নয়ন সূচকের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই প্ল্যাটফর্মে জনসাধারণ, সাংবাদিক, নীতি-নির্ধারক এবং গবেষকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তথ্য বিশ্লেষণ করে বাস্তবভিত্তিক পর্যালোচনার সুযোগ পাচ্ছেন।

একইভাবে স্থানীয় পর্যায়ে ৩৯+১ মডেলের মাধ্যমে ‘এসডিজি স্থানীয়করণ’ কর্মসূচি চালু করা হয়েছে, যার মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে রূপান্তর করা হচ্ছে। এই মডেল শুধু একটি কৌশলগত উদ্যোগ নয়—এটি স্থানীয় জনগণের জন্য অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে নিজেদের উন্নয়নের রূপরেখা নির্ধারণের অধিকার প্রদান করছে।


অদৃশ্য প্রাচীরের বাস্তবতা

তবে এত কিছুর পরও অস্বীকার করার সুযোগ নেই—ডিজিটাল বৈষম্য এখনো বাংলাদেশের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশে ১৩ কোটির বেশি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী হলেও, তা সমানভাবে বিস্তৃত নয়। বিশেষ করে গ্রামীণ, চরাঞ্চল, হাওর-বাঁওড় বা পার্বত্য এলাকার জনগণ এখনও নির্ভরযোগ্য সংযোগ পান না।

এছাড়া নারীদের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের হার এখনও পুরুষদের তুলনায় অনেক কম, এবং প্রযুক্তি ব্যবহারে তাঁদের সামাজিক প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে নারীদের মাত্র ৩৪% মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার গড় হলো প্রায় ৪৮%। এই ডিজিটাল বিভাজন শুধু প্রযুক্তিগত সমস্যাই নয়—এটি এক ধরনের কাঠামোগত বৈষম্য, যা রূপান্তরের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে।


প্রযুক্তি সংস্কৃতিও বটে

যদি সত্যিকারের রূপান্তরের দশ্যকল্প বাস্তবায়ন করতে চাই, তবে আমাদের প্রযুক্তিকে দেখতে হবে কেবল উদ্ভাবনের যন্ত্র হিসেবে নয়, বরং একটি সামাজিক ও নৈতিক সংস্কৃতি হিসেবে। একটি সংস্কৃতি, যেখানে রাষ্ট্র নাগরিককে শুধু ‘সেবাগ্রহীতা’ হিসেবে দেখে না, বরং ‘অধিকারভিত্তিক অংশীদার’ হিসেবে সম্মান দেয়।

প্রযুক্তির হাত ধরে আমরা কেমন সমাজ চাই? একটিই উত্তর হতে পারে—একটি ন্যায়ভিত্তিক, সমতা-নির্ভর, মর্যাদাপূর্ণ সমাজ, যেখানে কেউ পিছিয়ে পড়বে না কেবলমাত্র জন্মসূত্রে, অবস্থানগত কারণে, বা দারিদ্র্যের কারণে। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য দরকার প্রযুক্তি, নীতি, সামাজিক সংলাপ এবং মানুষের সচেতনতার সম্মিলিত উদ্যোগ।

রূপান্তরের দশ্যকল্প একটি রাষ্ট্রীয় ঘোষণা নয়, এটি একটি সম্মিলিত জাতীয় প্রত্যয়। এর সার্থকতা তখনই ঘটবে, যখন দেশের প্রতিটি মানুষ অনুভব করবে—তিনি এই রূপান্তরের অংশ, তিনি এর উপকারভোগী, এবং তিনিও একে এগিয়ে নেওয়ার শক্তি ধারণ করেন। সেই সম্ভাবনাময় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ার রূপরেখাই আজকের বাংলাদেশ রচনা করছে, প্রযুক্তির হাত ধরে—ন্যায়বিচার, মর্যাদা এবং সমতার ভিত্তিতে।


Logo

অনুসরণ করুন