Logo
Logo
×

প্রযুক্তি

সরকারি সেবায় তথ্যপ্রযুক্তির দুই যুগ, কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ?

Icon

আইটি ডেস্ক

প্রকাশ: ১৩ মে ২০২৫, ১৭:৪৬

সরকারি সেবায় তথ্যপ্রযুক্তির দুই যুগ, কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ?

আমরা আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনায় তথ্যপ্রযুক্তির গুরুত্ব এবং ডিজিটাল রূপান্তরের বিষয়টি যখন আলোচনা করি, আমাদের মনে তখন প্রশ্ন জাগে, আমরা কি উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে নিজেদের তুলনা করতে পারি? অনেকের দৃষ্টিতে এটি অমূলক মনে হলেও বাস্তবতার নিরিখে যদি দেখা যায়, তবে সেই তুলনাটি আদতে কেমন? তুলনামূলক নাকি অমূলক, তা বোঝা যায় কিছু নির্দিষ্ট উদাহরণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে। বিশেষ করে এস্তোনিয়া ও সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলোর ই-গভর্নেন্স কার্যক্রম এবং বাংলাদেশ সরকারের চলমান কার্যক্রমের মাঝে কিছু সাদৃশ্য ও পার্থক্য বিশ্লেষণ করলে এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া যেতে পারে।

এস্তোনিয়া, ইউরোপের এক ক্ষুদ্র রাষ্ট্র, নব্বইয়ের দশকে স্বাধীন হওয়ার পর ছিল পিছিয়ে পড়া একটি দেশ। তবে ১৯৯৭ সালে অনলাইনে সরকারি সেবা দেওয়ার মাধ্যমে তারা প্রযুক্তিনির্ভর সমাজ গঠনের পথে হাঁটা শুরু করে। প্রযুক্তিকে নাগরিক অধিকার হিসেবে বিবেচনা করে ২০০২ সালের মধ্যেই এস্তোনিয়া দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করে। এই পদক্ষেপ শুধু ইন্টারনেটের বিস্তারে নয়, বরং নাগরিক সেবার ডিজিটাল রূপান্তরের একটি ভিত্তি তৈরি করে দেয়। দশ বছর পর, ২০১২ সালের মধ্যেই সরকারি কার্যক্রমের প্রায় ৯০ শতাংশ অনলাইনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। এর ফলে প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রতা কমে, এবং নাগরিকেরা সহজেই সরকারি সেবা পেতে শুরু করে।

এর চেয়েও চমকপ্রদ হচ্ছে ‘এক্স রোড’ নামক একটি ওপেন সোর্স প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার, যা সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে নিরাপদ তথ্য বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। এর মাধ্যমে নাগরিকরা তাদের ডিজিটাল পরিচয়, কর প্রদান, ব্যাংকিং কার্যক্রম ও অন্যান্য সেবাগুলো নিরাপদে নিতে পারেন। এমনকি, ২০১২ সালে বিশ্বে প্রথমবারের মতো উৎপাদন ব্যবস্থায় ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করে এস্তোনিয়া, যা ডাটা নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতার এক অনন্য উদাহরণ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। পরে তারা ‘ডাটা দূতাবাস’ ধারণা ও ‘ই-রেসিডেন্সি’ চালু করে, যা বিশ্বব্যাপী যে কারও জন্য তাদের ডিজিটাল নাগরিক হওয়া সম্ভব করে তোলে।

অন্যদিকে সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতাও এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। ১৯৬৫ সালে স্বাধীন হওয়ার পর, তারা যখন অর্থনৈতিকভাবে টালমাটাল, তখন আশির দশকে একটি আধুনিকীকরণ কর্মসূচির সূচনা করে এবং প্রযুক্তিকে এর কৌশল হিসেবে গ্রহণ করে। ’৯০ দশকের মাঝামাঝিতে ‘সিঙ্গাপুর ওয়ান’ নামে একটি সমন্বিত ব্রডব্যান্ড অবকাঠামো তৈরি হয়, যার আওতায় পড়ে পুরো দেশ। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের ওয়েবসাইট চালু হলেও, সেগুলোর মধ্যে আন্তঃসংযোগের অভাব ছিল। এই চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে ১৯৯৯ সালে ‘ওয়ানস্টপ ই-সিটিজেন’ চালু করে সিঙ্গাপুর সরকার, যার মাধ্যমে সব সরকারি সেবা একটি প্ল্যাটফর্মেই নাগরিকদের জন্য উন্মুক্ত হয়।

শুধু অবকাঠামো তৈরি নয়, বরং সিঙ্গাপুর সরকার সাধারণ মানুষের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারে সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ধারাবাহিকভাবে কাজ করেছে। দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে প্রযুক্তি থেকে বঞ্চিত না করতে সেকেন্ড-হ্যান্ড পিসি বিতরণ করেছে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর সহযোগিতায়। একই সঙ্গে প্রযুক্তি ব্যবহারে সরকারি কর্মচারীদের দক্ষতা উন্নয়নে নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও অভ্যন্তরীণ উদ্ভাবনী সভার আয়োজন করে আসছে।

এই দুই দেশের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, একটি রাষ্ট্র চাইলে পরিকল্পিত ও ধারাবাহিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে কীভাবে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থার রূপান্তর ঘটাতে পারে, তা স্পষ্ট হয়। তখনই প্রশ্ন আসে, বাংলাদেশ এই তুলনায় কোথায় দাঁড়িয়ে?

বাংলাদেশ সরকারের চালু করা ‘মাই গভ’ প্ল্যাটফর্মটির মাধ্যমে সকল সরকারি সেবা একজায়গায় নিয়ে আসা শুরু হয়েছে। এস্তোনিয়ার ‘এক্স রোড’ এবং সিঙ্গাপুরের ‘ওয়ানস্টপ ই-সিটিজেন’- এর অনুরূপ চিন্তা থেকেই এর জন্ম। টেলিমেডিসিন ও অনলাইন স্বাস্থ্য সেবা চালু হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে ই-হেলথ কার্ডের মতো পরবর্তী ধাপে পা রাখছে। প্রযুক্তিনির্ভর সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সরকারি দপ্তরগুলো আগের তুলনায় অনেক বেশি সাড়া দিচ্ছে এবং নিজেরাই নিজেদের সেবা দেওয়ার পদ্ধতি উন্নতি করার বিষয়ে ভাবছে।

তবে পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা বিবেচনা করলে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জগুলোকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। এস্তোনিয়ার মোট জনসংখ্যা ১৪ লাখ এবং তাদের জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে মাত্র ৪০ জন, যেখানে বাংলাদেশে এই ঘনত্ব ৩৫০০ জনেরও বেশি। অর্থাৎ ৭৫ গুণ বেশি জনসংখ্যার ঘনত্বের চাপ রয়েছে বাংলাদেশের ওপর। সিঙ্গাপুরও মাত্র ৬০ লাখ জনসংখ্যার একটি দ্বীপদেশ, যেখানে ইন্টারনেট অবকাঠামো তৈরি সহজ। বাংলাদেশ আয়তনে সাড়ে তিন গুণ বড়, এবং সেখানে একই সঙ্গে জনসংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় রূপান্তর বাস্তবায়ন কঠিন ও সময়সাপেক্ষ।

তারপরও বাংলাদেশ বিগত দুই দশকে একটি সুগঠিত ই-গভর্নেন্স অবকাঠামো তৈরি করতে পেরেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির আওতায় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে জনগণের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন দেশের ৯০ শতাংশ প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সরকারি সেবা ইন্টারনেটের মাধ্যমে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। কোভিড মহামারির সময় প্রায় ১৩ কোটি মানুষকে জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই করে সফলভাবে টিকা দেওয়া এর একটি বড় উদাহরণ।

তবে এই অগ্রগতির মাঝেও আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই। কারণ প্রযুক্তির জগতে স্থবিরতা মানেই পিছিয়ে পড়া। উদ্ভাবনের চর্চা, দক্ষ জনবল তৈরি, এবং প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করাই ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করা উচিত, তবে অন্ধভাবে নয়—বরং নিজেদের বাস্তবতা বুঝে, তাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে, আমাদের পথ তৈরি করা জরুরি।

তাই প্রশ্নটা আসলে তুলনামূলক না অমূলক নয়, বরং যথাযথ তুলনা করা কতটা প্রয়োজনীয় এবং কীভাবে তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে, সেটিই আসল বিষয়। তুলনা তখনই ফলপ্রসূ হয়, যখন তা শুধুই অনুসরণ নয়, বরং আত্মসমালোচনা ও সামর্থ্য যাচাইয়ের একটি প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশ যদি সেই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ই-গভর্নেন্সে তার যাত্রা অব্যাহত রাখে, তবে তুলনাগুলো শুধু বাস্তবই নয়, বরং ভবিষ্যতের পথে দিশাও হতে পারে।

তুলনার সেই দিশায় এগিয়ে যেতে হলে আমাদের দরকার ধারাবাহিকতা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দক্ষ মানবসম্পদ, এবং সর্বোপরি জনগণের অংশগ্রহণ। প্রযুক্তির এই যুগে রাষ্ট্র পরিচালনায় ই-গভর্নেন্স আর বিলাসিতা নয়, বরং অপরিহার্যতা। এবং সেই অপরিহার্যতার পথে আমাদের এগিয়ে যাওয়া এখন সময়ের দাবি। অতএব, এস্তোনিয়া ও সিঙ্গাপুরের উদাহরণকে আমরা কেবল তুলনার জন্য না দেখে যদি তাদের পথনির্দেশনা হিসেবে গ্রহণ করি, তবেই তা হবে একটি যথার্থ এবং গঠনমূলক প্রয়াস।


Logo

অনুসরণ করুন