
দুই দশক আগেও বাংলাদেশে সরকারি সেবার মানে ছিল কাগজপত্রের পাহাড়, দিনের পর দিন দৌড়ঝাঁপ আর অস্পষ্ট দায়িত্ববোধের এক প্রশাসনিক গোলকধাঁধা। মানুষ সরকারি অফিস বলতে যা বুঝত, তা ছিল ধীরগতির এক প্রক্রিয়া—যেখানে প্রযুক্তির উপস্থিতি ছিল নামমাত্র, আর জনগণের অভিযোগ শোনা হতো একরকম আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবেই। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে এই দৃশ্যপট। আজ বাংলাদেশের নাগরিকেরা অনেক সরকারি সেবা পাচ্ছেন ঘরে বসেই, একটি ক্লিকেই, কোনো দালাল ছাড়াই। এই পরিবর্তনের পেছনে আছে দীর্ঘ পথচলা, নীতিগত অঙ্গীকার, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে—উদ্ভাবনের চর্চা ও সংস্কৃতি।
বাংলাদেশে ই-গভর্নেন্স বা ডিজিটাল প্রশাসনের ধারণাটি প্রথম আলোচনায় আসে ২০০১ সালে। ২০০১ সালের ‘ওয়ার্ল্ড সামিট অন দ্য ইনফরমেশন সোসাইটি’ (WSIS) সম্মেলনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ২০০২ সালে আইসিটি নীতিমালা প্রণয়ন করে এবং ২০০৩ সালে ই-গভর্নেন্সের সূচনা হয় এসএআইসিটি প্রকল্পের মাধ্যমে। ২০০৪ সালে ইউএনডিপির সহায়তায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ই-গভর্নেন্স কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন প্রকল্প শুরু হয়, প্রশাসনে প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়াতে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে আইসিটি ফোকাল নিয়োগ দেওয়া হয় এবং ৫০টি সরকারি ফরম অনলাইনে প্রকাশ করা হয়।
২০০৬ সালে ই-গভর্নেন্স সেল ও এটুআই প্রোগ্রাম অনুমোদিত হয় এবং ইউএনডিপি প্রোগ্রাম ইনিশিয়েশন ডকুমেন্ট তৈরি করে। পাশাপাশি, বিশ্বব্যাংকের ইএমটিএপি প্রকল্প আইসিটি ব্যবহারে সুপারিশ দেয়। সবচেয়ে বড় উদ্যোগটি ছিল ২০০৭-২০০৮ সালে ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা তৈরির কাজ।
এভাবে ক্রমশ প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয় জনগণের সরাসরি সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে। ইউনিয়ন পরিষদে চালু হয় ডিজিটাল সেন্টার—যেখান থেকে জন্মনিবন্ধন, নাগরিক সনদ, জমির কাগজ, আবেদনপত্র, ছবি প্রিন্টিংসহ নানা সেবা পাওয়া যায় সহজে। এর ফলে মানুষ আর ইউনিয়ন অফিসে ঘুরে ঘুরে হয়রানির শিকার হতে থাকেনি। ডিজিটাল পদ্ধতিতে সময় বাঁচেছে, দুর্নীতি কমেছে, এবং মানুষের মধ্যে সরকারি সেবার প্রতি আস্থা বেড়েছে।
এই রূপান্তরের একটি মূল চালিকা শক্তি ছিল উদ্ভাবনী চিন্তাধারা। উদ্ভাবন মানে শুধু নতুন কিছু আবিষ্কার নয়, বরং পুরোনো পদ্ধতিকে নতুনভাবে চিন্তা করে আরও কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য করা। বাংলাদেশ সরকার ঠিক সেটিই করেছে। উদাহরণস্বরূপ, আগে যেখানে জমির নামজারি করতে মাসের পর মাস সময় লাগত, এখন সেটি করা যাচ্ছে অনলাইনে। ভূমি উন্নয়ন করও দেওয়া যাচ্ছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। আর এ সব সম্ভব হয়েছে কারণ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো তাদের পুরোনো পদ্ধতিকে প্রশ্ন করেছে, এবং তার উত্তর খুঁজেছে প্রযুক্তির মাধ্যমে।
স্বাস্থ্যখাতেও দেখা গেছে ব্যাপক পরিবর্তন। ‘৩৩৩’ নম্বর চালুর মাধ্যমে সাধারণ মানুষ খুব সহজেই সরকারি সেবার তথ্য জানতে পারছেন, কিংবা সামাজিক সমস্যা নিয়ে অভিযোগ জানাতে পারছেন। এই ধরনের টোল ফ্রি হেল্পলাইন চালুর চিন্তাটা এসেছে জনগণের দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যাকে বোঝার চেষ্টা থেকে—যা উদ্ভাবনের এক উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।
শুধু কেন্দ্র থেকে নয়, স্থানীয় পর্যায়েও অনেক উদ্ভাবনী উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে। বিভিন্ন উপজেলা প্রশাসন নিজস্ব ওয়েব পোর্টাল চালু করেছে, যেখান থেকে স্থানীয় বাসিন্দারা সরকারি ফরম ডাউনলোড, অভিযোগ দাখিল, কিংবা সেবার সময়সূচি জানতে পারছেন। শিক্ষকরা অনলাইনে শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট সংগ্রহ করছেন, আবার অনেক গ্রামীণ হাসপাতাল টেলিমেডিসিন চালু করেছে, যেখানে শহরের ডাক্তাররা অনলাইনে রোগী দেখছেন।
এই সব কার্যক্রম শুধু প্রযুক্তি ব্যবহারের ফল নয়—বরং প্রশাসনের মধ্যে একটি মানসিক পরিবর্তনের প্রতিফলন। উদ্ভাবন সংস্কৃতি মানে হলো নিজের কাজকে প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করা, এবং নতুন সমাধান খোঁজার মনোভাব তৈরি করা। আগে প্রশাসনের মধ্যে ‘এভাবেই তো চলে আসছে’—এই মনোভাব ছিল প্রবল। কিন্তু এখন ‘আরও ভালোভাবে করা যায় কিনা’—এই প্রশ্নটাই নেতৃত্ব দিচ্ছে।
তবে এই যাত্রাপথ খুব সহজ ছিল না। প্রথমদিকে প্রযুক্তি ব্যবহারে প্রশাসনিক দক্ষতার অভাব ছিল, অনেকেই পরিবর্তনকে ভয় পেতেন। আবার দেশের অনেক এলাকায় এখনও ইন্টারনেট সংযোগ দুর্বল, বিদ্যুৎ সমস্যা প্রকট। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে সরকার প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিয়েছে। প্রশাসনের কর্মীদের তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষম করে তোলা হয়েছে। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারগুলোতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তরুণ উদ্যোক্তা, যারা সেবার সাথে প্রযুক্তির সেতুবন্ধন তৈরি করছেন।
তথ্যপ্রযুক্তির এই বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসে—সাইবার নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনতা। এখন প্রায় সব সরকারি সেবা নিতে জাতীয় পরিচয়পত্র, মোবাইল নম্বর, ঠিকানা ইত্যাদি সংরক্ষিত হচ্ছে অনলাইন ডেটাবেসে। এক্ষেত্রে তথ্য ফাঁস বা অপব্যবহার প্রতিরোধে সরকারকে নিতে হয়েছে নানা নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ। উদাহরণস্বরূপ, জন্মনিবন্ধনের তথ্য এখন নির্ধারিত অথরাইজড আইডি ছাড়া পরিবর্তন করা যাচ্ছে না, এবং ডিজিটাল সিগনেচারের মাধ্যমে দাপ্তরিক স্বাক্ষর নিশ্চিত করা হচ্ছে।
তবে প্রযুক্তি আর উদ্ভাবনের ব্যবহার শুধু কাজের গতি বাড়ানোর জন্য নয়, বরং নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত করার হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। অনলাইন অভিযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে সাধারণ মানুষ এখন সরাসরি সরকারের কাছে নিজেদের সমস্যার কথা তুলে ধরতে পারছেন। আবার ‘মেজর গ্রিভান্স রিড্রেস মেকানিজম’-এর আওতায় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সমাধান নিশ্চিত করা হচ্ছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, ই-গভর্নেন্স শুধু প্রযুক্তি নির্ভর নয়, এটি একটি মানবিক, স্বচ্ছ, এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রশাসনিক কাঠামো গঠনের প্রক্রিয়া। এই কাঠামোর মূল ভিত্তি উদ্ভাবনের চর্চা, যেখানে প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের জন্য সেবা সহজতর করা হয়, আর রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যে সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হয়।
এই যাত্রা এখনও চলছে। প্রতিদিনই কোনও না কোনও দপ্তর তাদের সেবাকে তথ্য প্রযুক্তিতে রূপ দিচ্ছে। নতুন অ্যাপ, ওয়েবসাইট, ডেটাবেস তৈরি হচ্ছে। আবার মানুষের চাহিদাও পাল্টাচ্ছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাষ্ট্রকেও প্রতিনিয়ত নিজেদের বদলাতে হচ্ছে। এই বদলটাই ই-গভর্নেন্সের শক্তি।
২০০১ সালে যাত্রা শুরু করা তথ্যপ্রযুক্তির একটি উদ্যোগ তথা ই-গভর্নেন্স আজ বাংলাদেশের প্রশাসনকে বদলে দিয়েছে ভিতর থেকে। আর এই রূপান্তরের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল উদ্ভাবন, যা কেবল প্রযুক্তিনির্ভর নয়, বরং চিন্তার এক নতুন সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি যত গভীরে যাবে, তত সহজ হবে মানুষের জীবনে সরকারি সেবার প্রবাহ, এবং ততটাই দৃঢ় হবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি।