
বাংলাদেশে রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতিতে গত দুই দশকে যে বিশাল রূপান্তর দেখা গেছে, তার অন্যতম চালিকাশক্তি হলো 'ই-গভর্নেন্স' বা ইলেকট্রনিক গভর্নেন্স। রাষ্ট্রের সেবা পদ্ধতি, নীতিনির্ধারণ ও প্রশাসনিক কাজ-কর্মে তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। ই-গভর্নেন্স কোনও বিলাসিতা নয়, বরং একটি সময়োপযোগী প্রয়োজন। এটি মানুষের জীবনকে সহজতর ও রাষ্ট্রকে অধিক কার্যকর করে তুলছে। তবে এই প্রযুক্তিনির্ভর সেবার বিস্তারে শুধু যন্ত্র বা সফটওয়্যার নয়, এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি কাজ করছে তা হলো ‘উদ্ভাবন সংস্কৃতি’। অর্থাৎ সমস্যা দেখেই সমাধান খোঁজার মনোভাব, সেবাকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ, আর রাষ্ট্রকে আরও মানবিক করে তোলার প্রচেষ্টা, এ সব কিছুই মিলেমিশে উদ্ভাবনের ভিত্তি গড়ে তুলেছে।
এই উদ্ভাবনের প্রয়োজনীয়তা এসেছে বাস্তব জীবন থেকে। দেশের প্রতিটি প্রান্তেই মানুষ বিভিন্ন সরকারি সেবা নিতে গিয়ে নানা ধরনের হয়রানি ও জটিলতার সম্মুখীন হতেন। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা, অফিসে অফিসে ঘুরে কাজ করানো, দালালের খপ্পরে পড়ে টাকা গচ্ছা যাওয়া, কিংবা অজানা কারণে ফাইল আটকে থাকা, এই সব সমস্যার সঙ্গে যেন মানুষ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। এই সবের প্রতিকার কী হতে পারে, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই সামনে আসে প্রযুক্তিনির্ভর সমাধানের বিষয়টি। ফলে সরকার যখন প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দেয়, তখন তার কেন্দ্রে জায়গা পায় ই-গভর্নেন্স। আর তার মাধ্যমেই ধীরে ধীরে শুরু হয় সেবার রূপান্তর এবং নাগরিক অভিজ্ঞতার পরিবর্তন।
প্রযুক্তিনির্ভর এই রূপান্তরের ফলে সরকারি সেবার ক্ষেত্রে যে বড় পরিবর্তনটি এসেছে, তা হলো স্বচ্ছতা। আগের একজন নাগরিকের আবেদন প্রক্রিয়াধীন আছে কিনা, কে দেখছেন, কখন নিষ্পত্তি হবে, এ সব জানার কোনো উপায় ছিল না। এখন অনেক ক্ষেত্রেই আবেদন অনলাইনে করা যায় এবং আবেদন করা বিষয়টির হালনাগাদ তথ্যও অনলাইনে দেখা যায়। অর্থাৎ এক ধরনের জবাবদিহিতা তৈরি হয়েছে। ফলে দপ্তরগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন ও সাড়া দেওয়ায় তৎপর হয়েছে। এই স্বচ্ছতা শুধু দুর্নীতি রোধে সহায়তা করছে না, বরং নাগরিকদের মধ্যে একটি আস্থা তৈরি করছে রাষ্ট্রের ওপর।
এই আস্থার ভিত্তিতেই গড়ে উঠছে সহজলভ্যতার ধারণা। এখন আর একটি ট্রেড লাইসেন্স পেতে দিনের পর দিন কাগজপত্র হাতে নিয়ে অফিসে দৌড়াতে হয় না। জন্মনিবন্ধন, জমির খতিয়ান, শিক্ষা উপবৃত্তি, সামাজিক নিরাপত্তা বীমা বা ভাতা—সবই এখন মোবাইল ফোন কিংবা অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে করা যায়। শহরের মানুষ যেমন এই সুবিধা নিচ্ছেন, তেমনি গ্রামের কৃষক, দিনমজুর, নারী, এমনকি প্রতিবন্ধীরাও এই সুবিধার আওতায় আসছেন। ফলে সেবার গন্তব্য এখন অফিস ভবনের চার দেয়ালে সীমাবদ্ধ নয়, এটি সম্প্রসারিত হয়েছে ঘরে বসে মানুষের হাতে।
এই সহজলভ্যতা সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে এক ধরনের ক্ষমতায়নের সুযোগ দিয়েছে। বিশেষ করে নারীরা যারা আগে প্রশাসনিক বা প্রযুক্তিনির্ভর সেবা গ্রহণে পিছিয়ে থাকতেন, তারা এখন অনলাইনের মাধ্যমে সরকারি সেবা পেতে নিজের কাজ নিজেই করছেন। একজন মা তার সন্তানের জন্মনিবন্ধন করতে পারছেন, একজন নারী উদ্যোক্তা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিজের ব্যবসার লাইসেন্স নবায়ন করতে পারছেন, এই রকম বহু উদাহরণ এখন দেখা যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এতে করে নারীর আর্থ-সামাজিক ক্ষমতায়ন যেমন ঘটছে, তেমনি পরিবার ও সমাজেও তারা আরও বেশি প্রভাব ফেলছেন।
এই প্রযুক্তিনির্ভর সেবা বাস্তবায়নের পেছনে একটি জোরালো কাঠামো তৈরি হয়েছে, যার ভিত্তি উদ্ভাবনের মানসিকতা। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ডিজিটাল প্রশিক্ষণ চালু হয়েছে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষ করে তোলার জন্য নিবিড় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এক সময় যারা প্রযুক্তিকে ভয় পেতেন বা এটিকে বাড়তি ঝামেলা ভাবতেন, এখন তারাই এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে কাজের গতি বাড়াচ্ছেন। উদ্ভাবন মানে এখানে কোনো জটিল যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন নয়, বরং সহজ সমাধান খুঁজে নেওয়া, যা সাধারণ মানুষের সমস্যার বাস্তব প্রেক্ষাপটে কাজ করে।
এই উদ্ভাবনী ভাবনা আরও বিস্তৃত হয়েছে নাগরিকদের অংশ নেওয়ার মাধ্যমে। আগে যে সব সমস্যা কেবল মুখে মুখে ঘুরে বেড়াত, এখন সেগুলো সরাসরি সরকারের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। ‘৯৯৯’ অথবা ‘৩৩৩’- এর মতো কল সেন্টার সেবা কিংবা অনলাইন অভিযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে সাধারণ মানুষ এখন যে কোনও অনিয়ম বা দুর্ভোগের কথা জানাতে পারছেন। অনেক ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, প্রশাসন সজাগ থেকেও দেখছে কে কতটা কার্যকর। এটি এক প্রকার সামাজিক চুক্তির মতো, যেখানে সরকার এবং জনগণ, দুই পক্ষই স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতাকে গুরুত্ব দিচ্ছে।
এই পুরো প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের অর্জন অনেক। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভূমি ব্যবস্থাপনায় এখন ডিজিটাল মানচিত্র, খতিয়ান ও নামজারির অনলাইন পদ্ধতি চালু হয়েছে। শিক্ষা উপবৃত্তি এখন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। পাসপোর্ট, ট্রেড লাইসেন্স, ট্যাক্স ফাইলিং, ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন, এ সবই এখন প্রায় পুরোটাই ডিজিটাল। এমনকি দরিদ্রদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর ডিজিটাল তথ্যভাণ্ডার তৈরি হচ্ছে যাতে প্রকৃত সুবিধাভোগীকে নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত করা যায়।
তবে এই রূপান্তর নিখুঁত নয়। এখনো অনেক জায়গায় উচ্চগতির ইন্টারনেট সুবিধা নেই, অনেক মানুষ এখনো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে পারছেন না। ডিজিটাল সাক্ষরতা বা প্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতা এখনও সব স্তরে পৌঁছায়নি। আবার নিরাপত্তা ঝুঁকি, তথ্যের সুরক্ষা, ডেটা ম্যানেজমেন্ট, এ সব জায়গাতেও উন্নয়নের প্রয়োজন রয়েছে। যেহেতু নাগরিকদের ব্যক্তিগত ও সংবেদনশীল তথ্য এখন ডিজিটালভাবে সংরক্ষিত হচ্ছে, তাই সাইবার সুরক্ষা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।
এই চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবিলা করতে হলে আমাদের ভবিষ্যতের পরিকল্পনা আরও সুসংগঠিত হতে হবে। শুধু প্রযুক্তি সরবরাহ করলেই হবে না, এর সঙ্গে মানুষের মানসিকতা বদলানো, সচেতনতা তৈরি করা এবং ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। স্কুল-কলেজে 'ডিজিটাল নাগরিকত্ব' বিষয়ে পাঠ্যসূচি অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে, যাতে আগামী প্রজন্ম প্রযুক্তিনির্ভর রাষ্ট্রের উপযুক্ত নাগরিক হয়ে উঠতে পারে।
ই-গভর্নেন্স কেবল একটি প্রযুক্তিগত মডেল নয়, এটি একটি নতুন ধারার রাষ্ট্রচিন্তা। এই ধারায় রাষ্ট্র শুধু সেবা প্রদানকারী নয়, বরং অংশীদার, যে তার নাগরিকের সঙ্গে কাজ করে, তাকে কথা শোনে এবং তার সমস্যা সমাধানে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনকে কাজে লাগায়। উদ্ভাবনের সংস্কৃতি এই ই-গভর্নেন্স ব্যবস্থার প্রাণশক্তি, যা প্রতিনিয়ত রাষ্ট্র ও জনগণের মাঝে সেতুবন্ধন গড়ে তুলছে। আমাদের যাত্রা এখনও চলছে, এই যাত্রার পথটি হয়তো দীর্ঘ, তবে এটি আশাবাদের, অগ্রগতির এবং একটি দক্ষ, মানবিক, প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশের।