জনপদ জুড়ে ক্ষুধা। কিন্তু কোথাও কোন খাবার নেই। রিক্সাচালক একটু পাউরুটির খোঁজে একটা দোকানে যায়। দোকানদারের বিরাট দাড়ি, মাথায় টুপি, নামাজ পড়ে পড়ে ঘাঁটি পড়ে গেছে কপালে। দোকান জুড়ে ধর্মীয় পুস্তক, তজবিহ, গোলাপ জল, আগরবাতি কিন্তু কোন খাবার নেই। রিক্সাচালক জিজ্ঞেস করে, হুজুর খাওনের কিছু কি নাই!
--খালি খাই খাই করো কা। নামাজ পড়তে জানোকি! একটা সুরা শুনাও দেখি।
--হুজুর সারাদিন রিক্সা চালাইয়া খুব ক্ষুদা লাগছে।
--মুখ দিয়াছেন যিনি আহার দিবেন তিনি; খোদার ওপর ভরসা রাখো মিয়া। লও দেখি একটা টুপি কিনো, তোমারে দিয়া বৌনি করি।
রিক্সাওয়ালা টুপি কিনে মাথায় দিয়ে আরেকটা দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, এইখানে কি এক টুকরা পাউরুটি পাওন যাইবো।
মাথায় পতাকা বেঁধে এক যুবক সেখানে বসে। দোকান জুড়ে সাজানো মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থ, বিক্রির জন্য ঝুলছে সারি সারি পতাকা, শেখ হাসিনার ছবি, পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেলের ছবি, ক্যাসেট প্লেয়ারে গান বাজছে, জয় বাংলা বাংলার জয়।
রিক্সাচালক আবার জিজ্ঞেস করে, ও ভাই খাওনের কিছু নাই!
যুবক এবার রেগে গিয়ে বলে, অই মিয়া মাথায় টুপি ক্যান, তুমি কি রাজাকার নাকি!
--রাজাকার হমু ক্যামনে, আমি তো যুদ্দের বছর দেখি নাই; আমার জন্ম এরশাদ আমলে।
--ঐ জন্যে তো বেহায়া হইছো, চেতনার দোকানে পাউরুটি খোঁজো। দেশরে ভালোবাসতে শিখো। লও দেখি, একখান পতাকা কিনা নিয়া যাও। তোমারে দিয়া বৌনি করি।
টুপি পরে পতাকা হাতে নিয়ে পাশের দোকানে যায়। সেখানে এক ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো সংস্কৃতি মামা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান ধরেছে, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য। এক সংস্কৃতি খালা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে তার দিকে। দোকান জুড়ে রবীন্দ্র-নজরুলের ছবি ঝুলানো। বাঁশী-দোতরা-হারমোনিয়াম, তবলা, সুরবাহার ইত্যাদি বিক্রি হয় সেখানে।
রিক্সাওয়ালা জিজ্ঞেস করে, একটা পাউরুটি পাওন যাইবো, খুব ক্ষিদা লাগছে গো!
সংস্কৃতি খালা মুখ ঝামটা দিয়ে ওঠে, জানোনা কেউ গান গাইবার সময় কথা বলতে নেই। অশিক্ষিত কোথাকার। ও বাবা টুপিওয়ালার হাতে আবার পতাকা। এ এক নতুন ফ্যাশান হয়েছে; রাজাকার পতাকা নিয়ে ঘুরছে।
রিক্সাচালক প্রতিবাদ জানায়, আমি রাজাকার হমু ক্যান; আমারে একটা পাউরুটি দেন।
গান শেষ করে সংস্কৃতি মামা গম্ভীরভাবে বলে, শুধু পেটের ক্ষুধা থাকলে কি চলে, মনের ক্ষুধা কি তা বুঝতে শেখো। আনন্দভুক হও। রবীন্দ্রনাথের একটা ছবি নিয়ে যাও; জগতে আনন্দযজ্ঞে তোমার নিমন্ত্রণ।
সংস্কৃতিখালা তাকে পরামর্শ দেয়, দুখু মিয়ার একটা ছবি নিয়ে যাও; তোমার দুঃখ চলে যাবে।
রবীন্দ্র-নজরুল ছবিদুটি কিনে ক্ষুধায় আধমরা হয়ে আরেকটি দোকানে যায় রিক্সাচালক। সেখানে ঝুলছে শহীদ আবু সাঈদের ফটো। আছে ভাসানী ও যোগেন মণ্ডলের ফটো। আওয়াজ উডা, কথা ক এরকম সব বিপ্লবী গান বাজছে। দোকানে বসে নানারকম সংস্কার নিয়ে আলাপ করছে কিছু বৃদ্ধ, কিছু তরুণ।
মাথায় টুপি, হাতে জাতীয় পতাকা। বুকে পিঠে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের ছবি নিয়ে রিক্সাওয়ালা দাঁড়িয়ে, ক্ষিদায় থর থর করে কাঁপছে। সে অনুনয় করে, আমারে একটা পাউরুটি দেন।
এক যুবক উত্তর দেয়, আমরা ক্ষুধা সংস্কার নিয়ে আলোচনা করছি। আমরা চাই তোমার ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হোক। কিন্তু এরজন্য তোমাকে আওয়াজ উঠাতে হবে; যাতে তোমার এজেন্সি তৈরি হয়। নাও মজলুম জননেতা ভাসানীর ছবি নিয়ে যাও; উনি তোমাদের মতো মজলুমের নেতা ছিলেন।
ভাসানির ছবি নিয়ে আরেকটি দোকানে গেলে দোকানি সন্দেহের চোখে তাকায়, মাথায় টুপি, হাতে ভাসানির প্ল্যাকার্ড। দোকানজুড়ে রামের ও মোদির ছবি। গেরুয়া পোষাক পরে চন্দনচর্চিত আরো কিছু লোক বসে। নিজেদের মধ্যে ফিস ফিস করে বলে, লোকটা জঙ্গি হামলা করতে আসেনি তো, দেখে তো মনে হয় হিজবুত তাহরির।
রিক্সাওয়ালা কাকুতি করে, ও দাদা আমারে একটা পাউরুটি দেন; বিয়ান থিকা কিছু খাই নাই। আমি কিইনা নিমু।
দোকানি পেলব হাসি হেসে বলে, ওরে বাবা এটা পাউরুটির দোকান নয়। তুমি এখন এসো দিকিনি। আমাদের রামনামের সময় হয়ে এলো। নাও রুদ্রাক্ষের একটা মালা নিয়ে যাও। এটা পরে যদি ঘর ওয়াপসির ইচ্ছে জাগে তবে এসো।
রিক্সাওয়ালা রুদ্রাক্ষের মালা পরে, এক হাতে পতাকা, আরেকহাতে ভাসানির ছবি, বুকে পিঠে রবীন্দ্র নজরুল; আর মাথায় টুপি। কিন্তু পাকস্থলী শূন্য তার। সেখানে শতবর্ষের ক্ষুধার স্মৃতি। ফুটপাথের পাশে রিক্সা রেখে ফুটপাথে শুয়ে পড়ে সে। শরীর কাঁপছে। জ্বরে কপাল পুড়ে যাচ্ছে।
একটি লাল সালোয়ার কামিজ পরা, গাঢ় লাল লিপস্টিক, পাউডারে সজ্জিত মেয়ে রিক্সাওয়ালাকে ফুটপাথে গড়িয়ে পড়তে দেখে দৌড়ে এসে তার চোখে মুখে পানি দেয়। ব্যাগ থেকে পাউরুটি বের করে ছিঁড়ে ছিঁড়ে তার মুখে দেয়।
একটা গোঁফওয়ালা মুষকো লোক এসে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করে, ঐ কত হইলে যাবি সুন্দরী!
--আপনে অহন যান গিয়া, অহন মানুষটারে আগে বাঁচাই; জান বাঁচানো ফরজ।
রিক্সাওয়ালা লোকটার হাতের মুঠোতে পতাকাটাতে হাওয়া লেগে তা পতপত করে উড়তে থাকে।