গণমাধ্যমকর্মীর লাঞ্ছনার পুরোনো বয়ান এবং সফট পাওয়ার সামলাতে ব্যর্থতা
কাকন রেজা
প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৫:১৪
মিনহাজ আমান। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের একজন কর্মী। কাজ করেন ফ্যাক্টচেক নিয়ে। এই মুহূর্তে ফ্যাক্টচেক বিষয়টি অতিব রকম জরুরি হয়ে উঠেছে, ভারতীয় প্রোপাগান্ডার বিপরীতে। সুতরাং মিনহাজ আমানদের কাজের গুরুত্ব কতটা তা ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু সেই সাংবাদিককে লাঞ্ছিত করলেন, নারায়ণগঞ্জের ইকবাল হোসেন নামের এক বিএনপি নেতা। সম্ভবত সেই নেতা শামীম ওসমানের বিকল্প হয়ে উঠতে চাইছেন। না হলে লাঞ্ছনার পর সেই নেতা তার ভিজিটিং কার্ড হাতে ধরিয়ে দিয়ে চ্যালেঞ্জ করতে না। বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কমিটি এই ঘটনার পর যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে। বহিষ্কার করা হয়েছে সেই নেতাকে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত বিএনপির প্যাডে বহিষ্কারের সুনির্দিষ্ট কারণ জানিয়ে ইকবাল হোসেনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ধন্যবাদ বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে। তারা অন্তত বোঝেন গণমাধ্যম কতটা জরুরি ধসে পড়া রাজনীতির বিনির্মাণে। তারা বোঝেন, গণমাধ্যমের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে ঘাটতি থাকায় তাদের কতটা পিছিয়ে পড়তে হয়েছে, হয়েছিলো। এই বহিষ্কার তাদের সেই বোধেরই বহিঃপ্রকাশ।
সব ঠিক আছে, কিন্তু মুশকিল হলো এমন ইকবাল হোসেনের সংখ্যা দলে কিন্তু কম নয়। সারাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এমন অসংখ্য ইকবাল হোসেন। আর সেই হোসেনদের কাছ থেকে গণমাধ্যমকর্মীরা নিরাপদ নন। এমনকি আমিও নই। জানি, আমি আক্রান্ত হলে আমার পাশেও হয়তো দাঁড়াবেন আন্তজার্তিক অঙ্গন থেকে দেশের অঙ্গনের অনেক বন্ধু-সহকর্মী। হয়তো সেই হোসেনকেও বিএনপি বহিষ্কার করবে। কিন্তু বহিষ্কারই কি শেষ কথা? না। প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিউর। বিএনপির সুপ্রিমো তারেক রহমান, যিনি নিজেই তাকে নিয়ে কার্টুন আঁকতে আহ্বান জানিয়েছেন। যিনি সবসময় সমালোচনাকে গ্রহণ করার কথা বলেছেন, বলছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন পর্যন্ত যারা ক্ষমতায় ছিলেন, তাদের মধ্যে বিএনপিকে গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম হার্মফুল ভাবা হয়েছে। গণমাধ্যমের প্রতি সবচেয়ে সহনশীল ছিলো এই দলটি। ফলে ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেও বেগম খালেদা জিয়ার কার্টুন প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে প্রথম আলো’র পক্ষে। সেই বিএনপি এখন ক্ষমতার দ্বারপ্রান্তে বলা যায়। সঙ্গত প্রিভেনশনের সবচেয়ে পিকটাইম এটাই। এই মুহূর্তে যদি বিএনপির সুনাম নষ্ট হয় এবং গণমাধ্যমের সাথে সংঘাত সৃষ্টি হয়, তাহলে সুযোগ নেবে তৃতীয়পক্ষ। এখনো গণমাধ্যম ফ্যাসিস্ট রেজিমের দখলে। যদিও পরিস্থিতির কারণে তারা চুপ করে আছে, কিন্তু সুযোগ পেলেই তারা তাদের চেহারা দেখিয়ে দেবে। গণমাধ্যমের সফ্ট পাওয়ারকে অস্বীকার করার কিছু নেই। সুতরাং বিএনপিকে এখনি প্রিভেনশন নিতে হবে। চিহ্নিত করতে হবে দলের মধ্যে গণমাধ্যমবিরোধী যারা আছেন কিংবা যাদের দ্বারা গণমাধ্যমের সাথে কনফ্লিক্ট সৃষ্টি হতে পারে এমন ব্যক্তিদের।
সফ্ট পাওয়ারের কথা যখন উঠলো, তখন এ বিষয়ে কিছুটা বলে নিই। বিএনপির কম্যুনিকেশন স্কিল সফ্ট পাওয়ার হ্যান্ডেলের ক্ষেত্রে বরাবরই কিছুটা দুর্বল ছিলো। যার ফলে বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্র, গণমাধ্যম, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিএনপি প্রায়সময়ই ছিলো ব্যাকফুটে। এই ব্যাকফুটে থাকার কারণে সফ্ট পাওয়ার ব্যবহার করে বিভিন্ন ইস্যুতে ন্যারেটিভ তৈরি করতো বিগত ফ্যাসিস্ট রেজিম। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ এই ন্যারেটিভ তৈরি করে এই সফ্ট পাওয়ারই আওয়ামী লীগকে চেতনার সোল এজেন্ট বানিয়ে দিয়েছিলো। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিলো আওয়ামী লীগ বিরোধী মানে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী। বলতে পারেন একটা ট্যাবু তৈরি হয়েছিলো, যাতে পবিত্র জ্ঞান করা হতো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী হিসেবে আওয়ামী লীগকে। তার বিপরীতে গেলেই বীর বিক্রম পর্যন্ত হয়ে যেত রাজাকার। একটা রেজিম দীর্ঘস্থায়ী হয় এই সফ্ট পাওয়ারের সুবাদেই। আর রেজিম দীর্ঘস্থায়ী হলে ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠা স্বাভাবিক। সিরিয়ার আসাদের ক্ষেত্রেও তাই দেখা গেছে। সিরিয়ার চিত্র আর আমাদের জুলাই বিপ্লবের চিত্র প্রায় একই। পার্থক্য শুধু আমাদের বিপ্লব নিরস্ত্র আর সিরিয়ার সশস্ত্র। আর না হলে একই দৃশ্যচিত্র সবখানেই। শ্রীলঙ্কার দৃশ্রচিত্রও একই ছিলো এবং প্রেক্ষাপটও।
সফ্ট পাওয়ারকে তাই উপেক্ষা করা হবে মারাত্মক রকম ভুল। মনে রাখতে হবে, সফ্ট পাওয়ারকে উপেক্ষা করা যায়, অস্বীকার করা যায় না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও জনমত তৈরিতে সফ্ট পাওয়ারের ভূমিকা ছিলো অত্যন্ত কার্যকর। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে কি অস্বীকার করা যাবে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে? যাবে না। দেশে-বিদেশে গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টদের তৎকালীন কার্যক্রম মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমর্থনের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো তা বলাবাহুল্য। ৭১ এর ধারাবাহিকতায় যে জুলাই বিপ্লব, তাতেও সফ্ট পাওয়ারের প্রয়োজনীয়তা ছিলো। বিপ্লবের দিনে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সাথে জড়িত মানুষেরা, শিল্পীরা, আঁকিয়েরা সবাই একসাথে হয়েছিলেন বলেই আগস্ট ভিক্টোরি পেয়েছিলাম আমরা। ১৯৭১ এর মার্চ যেমন ছিলো আমাদের জনযুদ্ধ শুরুর মাস এবং ডিসেম্বর বিজয়ের, তেমনি ২৪-এ জুলাই ছিলো আমাদের বিপ্লব শুরুর মাস এবং আগস্ট ভিক্টোরির। ১৯৭১ এর ডিসেম্বরের ধারাবাহিকতা ছিলো ২৪ এর আগস্ট। এটা বুঝতে হবে, সাথে বুঝতে হবে সফ্ট পাওয়ারের প্রয়োজনীয়তা। বিশেষ করে বিএনপিকে বুঝতে হবে অবশ্যই। কারণ তারা বর্তমান বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষের আশা-আকাঙক্ষাকে ধারণ করার দাবিদার।
শুধু বিএনপির কথা বলেই মিনহাজ আমানের লাঞ্ছনার বিষয়টি শেষ হয়ে যায় না। বিএনপি এখনো ক্ষমতায় নেই, তাদের বিচারিক কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হবার প্রশাসনিক উপায় নেই। কিন্তু সরকার তো রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রয়েছে, রয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়ও। তারা বিষয়টি নিয়ে কী ভেবেছেন কিংবা করছেন। খবরে দেখলাম এ বিষয়ে সেই পুলিশ স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তারা অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেবেন। এই যে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়ার বয়ান, সেটা তো ফ্যাসিস্ট রেজিমের বয়ান। যখন দেখা গেছে বিএনপি বা অন্য বিরোধীপক্ষের মানুষজন আক্রান্ত হয়েছে, তখন থানায় সেই বয়ান ছিলো, ‘অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেব’। ২৪ এর জুলাই পরবর্তী প্রেক্ষাপটও কি ফ্যাসিস্ট রেজিমকে ধারণ করবে? -প্রশ্নটা রইলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে।
লেখক : সাংবাদিক