Logo
Logo
×

জাতীয়

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্ট

ব্রিগেডিয়ার আযমীকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা

Icon

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮:৩৯

ব্রিগেডিয়ার আযমীকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছু ক্ষেত্রে নিজেই গুম-খুনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রয়াত জামায়াত নেতা গোলাম আযমের ছেলে অবসরপ্রাপ্ত  ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহ আমান আযমীকেও হত্যার পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। ভয়ঙ্কর এ তথ্য জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। সংশ্লিষ্ট কিছু কর্মকর্তা তাদের এ বিষয়ে তথ্য দিয়েছেন বলে সংস্থাটি জানিয়েছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ  সোমবার ৫৫ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ‘আফটার দ্য মুনসুন  রেভ্যুলুশন- এ রোডম্যাপ টু লাস্টিং সিকিউরিটি সেক্টর রিফর্ম ইন বাংলাদে' শিরোনামের প্রতিবেদনে  মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে র্যাবকে বিলুপ্ত করার দাবি জানানো হয়েছে। 

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে পুলিশ-র্যাবসহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণ করা হয়। তারা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি বিচার বিভাগের সংস্কারের সুপারিশের কথাও জানিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে আগামী মার্চে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক অধিবেশনে সংস্কারকে দীর্ঘমেয়াদি করতে প্রস্তাব উত্থাপনেরও পরামর্শ দিয়েছে এইচআরডব্লিউ। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, কমপক্ষে গত ১৫ বছর ধরে শেখ হাসিনার নিষ্পেষণমূলক হাতিয়ারের মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী। তারা পর্যায়ক্রমে বিরোধীদলীয় সদস্য, সমালোচক, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মীদের টার্গেট করেছে। এক্ষেত্রে বানোয়াট মামলা দেয়া হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, খেয়ালখুশিমতো গ্রেপ্তার এবং জোরপূর্বক গুম করা হয়েছে। 

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া পরিচালক এলেন পিয়ারসন বলেন, গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে গিয়ে বাংলাদেশে প্রায় ১ হাজার বাংলাদেশি প্রাণ দিয়েছেন। তারা বাংলাদেশে মানবাধিকারের ভবিষ্যৎ নির্মাণের একটি যুগান্তকারী সুযোগ এনে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার যদি দ্রুত এবং কাঠামোগত সংস্কার না করে তাহলে ভবিষ্যতের সরকারগুলো যেকোনো সময় দমন-পীড়নের পথে পরিচালিত হতে পারে। যদি এমনটা হয় তাহলে কষ্টার্জিত অভূতপূর্ব এই সুযোগ সম্পূর্ণরূপে হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। 

প্রতিবেদনের নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের নির্যাতন বা ক্ষমতার অপব্যবহার অংশে বলা হয়েছে, জোরপূর্বক গুমের ঘটনা তদন্তের জন্য ২০২৪ সালের ১৪ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে একটি কমিশন। তারা প্রথম যে রিপোর্ট দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে কমপক্ষে ৩ হাজার ৫০০ মানুষকে গুম করা হয়েছে। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, একটি ‘কেন্দ্রীয় কমান্ড কাঠামোর অধীনে গুম করা হতো। গুমের ঘটনা দেখাশোনা করতেন স্বয়ং শেখ হাসিনা এবং তার শীর্ষ কর্মকর্তারা। তার মধ্যে আছেন মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিক, মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম এবং মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ। তারা এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। গুমের সঙ্গে জড়িত থাকা কর্মকর্তারা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন, আটকের বিষয়ে শেখ হাসিনা ও তার সরকারের সিনিয়র সদস্যরা জানতেন। তবে এটা প্রকাশ করা হতো না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে গুম এবং হত্যাকাণ্ডের সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন শেখ হাসিনা। একজন সেনা কর্মকর্তা বলেছেন, ব্রিগেডিয়ার আযমীকে আটকের বিষয়ে সরাসরি জানতেন হাসিনা। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, যেহেতু আযমী একজন সেনা কর্মকর্তা ছিলেন, তাই শেখ হাসিনার কাছে তিনি মুক্তি দেয়ার আবেদন জানাতে থাকেন। কিন্তু প্রতিবারই তার আবেদন নাকচ করেন হাসিনা। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, এক পর্যায়ে শেখ হাসিনা পরামর্শ দেন আযমীকে মেরে ফেলতে। 

ওই কর্মকর্তার ভাষায়- ‘আমি সেটা করতে পারিনি। আমি থেমে গিয়ে তাকে মুক্তির বিষয়ে কথা বলেছি’। আযমীকে যখন মুক্তি দেয়া হয় তার আগেই শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। 

প্রতিবেদনে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের নিয়ম লঙ্ঘনের বিশদ বর্ণনা দিয়েছে। বলা হয়, শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর মাইকেল চাকমা, মীর আহমেদ বিন কাসেম (আরমান) ও আবদুল্লাহ আমান আযমীকে মুক্তি দেয়া হয়। তিনজনের ক্ষেত্রেই কর্তৃপক্ষ তাদের হেফাজতে থাকা এসব ব্যক্তির বিষয় অস্বীকার করেছে। তারা সবাই সাংবাদিকদের বলেছেন, তাদের নিঃসঙ্গ কারাবাসে রাখা হয়েছিল। একই বন্দিশিবিরে তারা অন্য বন্দিদের কথা শুনতে পেতেন। হুম্মাম কাদের চৌধুরীকে আটক করা হয় ২০১৬ সালের আগস্টে। প্রায় কাছাকাছি সময়ে আযমী ও আরমানকেও আটক করা হয়। তারা তিনজনই বিরোধীদলীয় নেতাদের ছেলে। এসব বিরোধীদলীয় নেতা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অভিযুক্ত হয়ে বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। হুম্মাম হলেন বিএনপি’র প্রয়াত নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে। বেআইনিভাবে আটকে রাখার বিষয়ে মুখ বন্ধ রাখবেন এই শর্তে তাকে ২০১৭ সালের মার্চে মুক্তি দেয়া হয়। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পরেই শুধু তিনি হিউম্যান রাইটস ওয়াচের কাছে মুখ খুলতে সক্ষম হয়েছেন। ওদিকে মীর আহমেদ বিন কাসেম (আরমান) তার পিতা মীর কাসেম আলীর আইনি টিমের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। মীর কাসেমকেও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত একই অভিযোগে অভিযুক্ত করে শাস্তি দেয়। ২০১৬ সালের ৯ই আগস্ট সাত থেকে আট সদস্যের একদল অফিসার তার বাড়ি থেকে স্ত্রী, বোন ও সন্তানের সামনে থেকে আরমানকে তুলে নিয়ে যায়।

আইনজীবী হিসেবে তিনি তাকে গ্রেপ্তারের পরোয়ানা দেখতে চান। কিন্তু কর্মকর্তারা তা প্রত্যাখ্যান করে তাকে বাসার  ভেতর থেকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যান। তাকে একটি ভ্যানে তোলে এবং চোখ বেঁধে ফেলে। তিনি এর প্রতিবাদ করলে একজন কর্মকর্তা তাকে বলেন- আমাদেরকে নিষ্ঠুর হতে বলবেন না। ওদিকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় একজন কর্মকর্তা তাকে আটক করার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। আরমানের গুমের বিষয়ে দেখাশোনা করেছেন এমন সাবেক আরেকজন উচ্চ পর্যায়ের কমান্ডিং অফিসার বলেছেন, এ ধরনের আটকের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক এবং সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তিনি আরও বলেন, যখন তিনি জিজ্ঞাসাবাদ টিমে যোগ দেন তখন তাকে বলা হয় আরমান, আযমী ও চৌধুরী হলেন বিরোধী দলের প্রথম সারির তিন নেতার সন্তান। তাদের মুক্তি দেয়ার যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন শেখ হাসিনা। বিরোধী দলের তিন নেতার এই তিন ছেলেকে কীভাবে তুলে নেয়া হয় এবং তাদের সঙ্গে কি নির্যাতন করা হয়েছে, তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ওই রিপোর্ট। এতে বলা হয়, একজন কর্মকর্তা বলেছেন, র্যাব, ডিবি এবং ওই সময়ের বিভিন্ন এজেন্সির কর্মকর্তারা অনেক মানুষকে হত্যা করেছে। 

Logo

অনুসরণ করুন