Logo
Logo
×

জাতীয়

সংগীত শিক্ষাকে বিশ্ব গুরুত্ব দিলেও উল্টো পথে হাঁটছে বাংলাদেশ

Icon

ইউএনবি

প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৫, ১৫:১২

সংগীত শিক্ষাকে বিশ্ব গুরুত্ব দিলেও উল্টো পথে হাঁটছে বাংলাদেশ

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগ বাতিলের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন অভিমুখে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর গানের মিছিল আটকে দিয়েছে পুলিশ।

গত রবিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী এ গানের মিছিল শুরু করে। গানের মিছিলটি সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা ভবনের সামনে এলে পুলিশ বাধা দেয়।

এ সময় উদীচীর শিল্পীরা বলেন, তারা গানের মিছিল নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার গেট পর্যন্ত যাবেন। প্রধান উপদেষ্টাকে গান শোনাবেন। কিছুক্ষণ তর্কবিতর্কের পর পুলিশ গানের মিছিল ছেড়ে দেয়, ২ মিনিট পর মিছিলটি পুলিশের ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজির কার্যালয় অতিক্রম করার পর আবার সেটিকে থামিয়ে দেয় পুলিশ। তারপর আর মিছিলটিকে সামনে যেতে দেয়নি পুলিশ। এ সময় সড়কে অবস্থান করে গান পরিবেশন করে উদীচীর শিল্পীরা।

এর আগে গত ২ নভেম্বর, সরকার প্রকাশিত সংশোধিত বিধিমালায় সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগের সুযোগ বাদ দেওয়া হয়েছে।

সচিব কমিটির সুপারিশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শরীরচর্চা ও সংগীত শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত থেকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সরে এসেছে বলে জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।

প্রেস উইং বলছে, সচিব কমিটি মনে করে, প্রকল্পটির পরিকল্পনায় ত্রুটি ছিল। এত অল্প সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে কার্যকর কোনো সুফল বয়ে আনবে না এবং এতে বৈষম্যের সৃষ্টি হবে। সারাদেশে ৬৫ হাজার ৫৬৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ের অধিকাংশেই প্রস্তাবিত নিয়োগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব না। ক্লাস্টার ভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা হলে একই শিক্ষককে ২০টির অধিক বিদ্যালয়ে যুগপৎভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। এর ফলে তার পক্ষে কর্মঘণ্টা ম্যানেজ করা সম্ভব হবে না বলে সচিব কমিটি মনে করে।

এর আগে, এ বছরের আগস্ট মাসের শেষ দিকে ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা’ প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করে সরকার। এতে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগের সুযোগ রাখা হয়। এর দুই মাসের মাথায় এসে সেই প্রজ্ঞাপন পরিবর্তন করা হলো।

সংশোধিত বিধিমালা প্রকাশের পরই নানা মহলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। সিদ্ধান্তে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি)। সংস্থাটি মনে করে করে, সরকারের এ সিদ্ধান্ত কেবল অযৌক্তিকই নয়, বরং একটি গোষ্ঠীর চাপে নতজানু হয়ে প্রাথমিক শিক্ষার কাঠামো থেকে এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ দেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ।

বিবৃতিতে বলা হয়, ‘সমাজের এক ক্ষুদ্র গোষ্ঠী নিজেদের চিন্তার সংকীর্ণতা থেকে ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে এর বিপরীতে অবস্থান ঘোষণা করলে সরকার সংগীত ও শারীরিক শিক্ষাবিষয়ক সহকারী শিক্ষক নিয়োগের বিধান বাতিল করে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করে।’ এদিকে, শনিবার বিকালে সমবেত কণ্ঠে গান পরিবেশনার মধ্য দিয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত ও শরীরচর্চার শিক্ষক পদে নিয়োগ বাতিলের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক শিক্ষায় সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগের পদ পুনর্বহালের দাবিতে ৫ নভেম্বর ক্যাম্পাসে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন।

অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে আয়োজিত এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীরা জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন এবং পদ বাতিলের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন।

সমাবেশে সংগীত বিভাগের চেয়ারম্যান ড. প্রিয়াংকা গোপে একটি স্মারকলিপি পাঠ করেন। অনুষ্ঠানে নৃত্যকলা বিভাগের লাবনী বান্যা, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বক্তব্য রাখেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক মোসাদ্দিক আলী ইবনে মোহাম্মদ এবং বিভিন্ন হলের সাংস্কৃতিক সম্পাদকরা উপস্থিত থেকে আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানান।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রস্তাব বাতিলের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সমাবেশে শিক্ষার্থীরা বলেন, সরকারের এ সিদ্ধান্ত দেশের ভবিষ্যৎ শিল্পচর্চা ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতির জন্য বড় হুমকি।

গানে গানে প্রাথমিকে সংগীত শিক্ষক নিয়োগ বাতিলের প্রতিবাদ জানিয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও।

ভিন্ন বৈশ্বিক বাস্তবতা

বৈশ্বিক বাস্তবতায় দেখা যায় বিশ্বের প্রায় সব দেশে, এমনকি বিশ্বের মুসলমানদের প্রাণ কেন্দ্র সৌদি আরব থেকে শুরু করে সবচেয়ে বেশি মুসলিম জনসংখ্যার দেশ ইন্দোনেশিয়াতে সংগীত শিক্ষা দেওয়া হয়। । ইসলামের প্রাণ কেন্দ্র সৌদি আরব, সম্প্রতি ভিশন ২০৩০’র অংশ হিসেবে সরকারি স্কুলে সংগীত শিক্ষা চালু করতে ৯,০০০-এর বেশি শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে। ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের নেতৃত্বে এই সংস্কার শিল্প, বিনোদন ও শিক্ষাকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশটি হাজারো কিন্ডারগার্টেন শিক্ষককে সংগীত দক্ষতায় প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। ২০২২ সালের শেষদিকে সরকারি ও বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনের ১২,০০০-এর বেশি নারী শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং নতুন পর্যায়ে প্রায় ১৭,০০০ নারী শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।

অন্যান্য মুসলিম প্রধান দেশগুলো—মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক ও মিশরেও জাতীয় পাঠ্যক্রমে সংগীত অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

মালয়েশিয়ায় ১৯৮৩ সাল থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলক সংগীত শিক্ষা চালু হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৭০-এর দশক থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সঙ্গীত বাধ্যতামূলক এবং ২০২২ সালের নতুন পাঠ্যক্রমেও তা বহাল আছে। তুরস্কে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ১ম থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত সপ্তাহে এক ঘণ্টা সঙ্গীত শিক্ষা পায়, এবং ৫ম থেকে ৮ম শ্রেণিতে অতিরিক্ত দুই ঘণ্টার ঐচ্ছিক পাঠ থাকে। মিশরে ১৯৩১ সাল থেকে সরকারি স্কুলের পাঠ্যক্রমে আরবি ও পাশ্চাত্য সঙ্গীত অন্তর্ভুক্ত।

যুক্তরাজ্যের (ইংল্যান্ড, নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস) বিদ্যালয়গুলোতেও বয়সভেদে সংগীত বাধ্যতামূলক। ইউরোপের ২০ দেশের ওপর পরিচালিত এমইনেট গবেষণা দেখিয়েছে, প্রাথমিক পর্যায়ে সঙ্গীত বাধ্যতামূলক; মাধ্যমিক পর্যায়ে এটি সাধারণত ঐচ্ছিক। এদিকে জার্মানি, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকাতেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত ও নৃত্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক।

যুক্তরাষ্ট্রের এনসিইএস (জানুয়ারি ২০২৫) অনুযায়ী, সরকারি বিদ্যালয়ের ৭৩% শিক্ষার্থী অন্তত একটি আর্টস কোর্স করতে বাধ্য, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংগীত (৮৪%) ও চিত্রকলা (৮২%)।

চীনে বাধ্যতামূলক নয় বছরের শিক্ষার সময় সংগীত বিষয় অন্তর্ভুক্ত এবং সাম্প্রতিক শিক্ষামূলক মানদণ্ডে এর গুরুত্ব আরও বেড়েছে।

কিন্তু বাংলাদেশে, বিশ্বজনীন প্রবণতার বিপরীতে, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ কয়েকটি ধর্মীয় সংগঠন ও রাজনৈতিক দল——সংগীত শিক্ষক নিয়োগের বিরোধিতা করছে। তারা এর বিপরীতে ধর্মীয় শিক্ষকের দাবি তুলেছে।

গত সেপ্টেম্বরে ইন্সটিটিউশন অফ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সের অডিটোরিয়ামে আয়োজিত এক সেমিনারে, সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা না হলে সড়ক আন্দোলনেরও হুমকি দেন তারা।

গবেষণা যা বলছে

যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে— সংগীত শেখা মস্তিষ্কের স্মৃতি, মনোযোগ, বিশ্লেষণ, ভাষা ও সমস্যা সমাধান–সংক্রান্ত অংশগুলোকে একইসঙ্গে সক্রিয় করে। মস্তিষ্কের দুই গোলার্ধ একযোগে কাজ করায় শিশুদের একাডেমিক সক্ষমতা, শৃঙ্খলা, মনোযোগ এবং আবেগ–নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। গবেষকেরা বলছেন, দলগত সংগীতচর্চা নেতৃত্ব, যোগাযোগ ও সহযোগিতার দক্ষতা গড়ে তোলে, যা পরবর্তী জীবনে প্রযুক্তি ও অন্যান্য ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

Logo

অনুসরণ করুন