কারিনা কায়সার বনাম সমাজে নারীর প্রথাগত সৌন্দর্য্যের মাপকাঠি
ইউএনবি
প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৩৭
শুধু মুখশ্রী ও শারীরিক গড়নের নিরীখে একজন নারীকে বিচার করা অনেক প্রাচীন ধ্যানধারণা। অথচ একবিংশ শতাব্দির তথ্য-প্রযুক্তির যুগেও এই সামাজিক স্টেরিওটাইপ থেকে বের হওয়া সম্ভব হয়নি। বরং আরও গেঁড়ে বসেছে সমাজের বেঁধে দেওয়া তথাকথিত সৌন্দর্যের মাপকাঠি। ফলে জন্মগত ভাবে যেসব নারী সেই শর্ত পূরণে অপারগ হচ্ছেন, তাদের বেছে নিতে হচ্ছে বিষণ্নতার জীবন। এমনি এক জীবনের বর্ণিল উপাখ্যান চরকি অরিজিনাল মুভি ৩৬-২৪-৩৬। ওটিটির আগেই প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে সিনেমাটির ভূয়সী প্রশংসা চলছে দর্শক মহলে। চলুন, ৩৬ ২৪ ৩৬ মুভিটির বিশদ বৃত্তান্তসহ জেনে নেওয়া যাক- কীভাবে চটকদার শিরোনামের চলচ্চিত্রটি বিস্তৃত পরিসরে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা পেল।
নেপথ্যের মানুষ
চরকি ও ছবিয়ালের ব্যানারে নির্মিত এই কমেডি নাট্য-চলচ্চিত্রটি চরকির মিনিস্ট্রি অব লাভ প্রকল্পের পঞ্চম ছবি। এই প্রকল্পের আওতায় এরই মধ্যে নির্মিত চারটি ছবি হলো- ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’, ‘মনোগামী’, ‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া’ ও ‘ফরগেট মি নট’।
‘৩৬-২৪-৩৬’-এর পরিচালনায় ছিলেন রেজাউর রহমান, যিনি মোনতাসির মান্নানের সঙ্গে ছবিটির গল্পও লিখেছেন। রচনায় আরও ছিলেন মুভির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করা সামাজিক মাধ্যমের কন্টেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবে খ্যাত কারিনা কায়সার। এটিই তার বড় পর্দায় প্রথম কাজ। মুভির কয়েকটি দৃশ্যে দেখা গেছে তার বাবা জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক খেলোয়াড় কায়সার হামিদ এবং মা লোপা কায়সারকে।
কারিনার সঙ্গে সিনেমার মূল চরিত্রগুলোতে ছিলেন সৈয়দ জামান শাওন, প্রার্থনা ফারদিন দীঘি, আবু হুরায়রা তানভীর এবং ডানা ভাই জোস খ্যাত কন্টেন্ট ক্রিয়েটর কামরুন নাহার ডানা।
অন্যান্য গুরুত্ব ভূমিকায় দেখা গেছে শহীদুল আলম সাচ্চু, মিলি বাশার, গোলাম কিবরিয়া তানভীর, মানস বন্দ্যোপাধ্যায়, তাপস কুমার মৃধা, রোজী সিদ্দিকী ও শামীমা নাজনীনকে।
২০২৪ সালের ৮ নভেম্বর ছবিটি দেশজুড়ে বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। অতঃপর ২৮ নভেম্বর থেকে ওটিটি চরকির গ্রাহকদের জন্যও ছবিটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
দুই স্তরের চিত্রনাট্য
হাস্যরস ও আবেগের মিশেলে ভরপুর পুরো গল্পটি চার বছর সময়ে দুটি ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে কেন্দ্রীয় চরিত্রকে ঘিরে গড়তে থাকে গল্পের গাঁথুনি।
এ অংশে সায়রাকে দেখা যায়, একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী হিসেবে। নিছক আবেগের বশে নয়; মেধাবী ও বাস্তববাদী সায়রা যেকোনো কিছু বিচার করে যুক্তি দিয়ে। আর এই বৈশিষ্ট্য তাকে করে তুলেছে অনুসরণীয় পেশাদারিত্ব ও উদ্যোগী দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী।
নিজের স্থুল শরীর নিয়ে খুব ব্যতিব্যস্ত হওয়ার সুযোগ তার নেই।এরপরেও পেশা যখন সামাজিক অনুষ্ঠান নিয়ে, তখন প্রায়ই তাকে সমাজের তথাকথিত দৃষ্টিভঙ্গি সামাল দিতে হয়। তখন অলক্ষ্যেই হৃদয়ের গহীনে কোথাও গুপ্ত বঞ্চিত বিষণ্ণ সত্ত্বাটির মুখোমুখি হতে হয় সায়রাকে। অবশ্য প্রতিবারই বিষয়টিকে মেনে নিয়ে পেশাদারিত্বের সঙ্গে নিজেকে সামলে নেয় সে।
কিন্তু মেঘমুক্ত আকাশে হঠাৎ বৃষ্টির মতো সায়রার জীবনে প্রেম নিয়ে আসে তাহসির। জীবন নিয়ে তার মনে এতদিন ধরে গড়ে ওঠা চিন্তা-চেতনা সব ভুল প্রতীয়মান করে ঘটতে শুরু করে অমূল্য কিছু ঘটনা। তবে বেশি দিন স্থায়ী হয় না এই সুখের অনুভূতি। হঠাৎ তাহসিরের সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারে না সায়রা। বহু কষ্টে তার বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগের পর জানতে পারে যে তাহসির ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দেশের বাইরে চিকিৎসাধীন। প্রচণ্ড শঙ্কায় মনোকষ্টে দিন কাটতে থাকে সায়রার। তাহসিরের আরোগ্য লাভের জন্য দোয়া করতে থাকে।
তারপর হঠাৎ একদিন সেই বন্ধু ফোন করে জানায়, তাহসির আর বেঁচে নেই। এর মধ্যে দিয়ে শেষ হয় সিনেমার প্রথম ভাগ।
দ্বিতীয় অংশে দেখা যায়- সায়রার নিজেরই একটা ওয়েডিং প্ল্যানিং প্রতিষ্ঠান হয়েছে। একসঙ্গে অনেক ক্ল্যায়েন্টকে সার্ভিস দিতে গিয়ে রীতিমত হিমশিম খেতে হয় তার টিমকে। এরই মধ্যে আবার এক পুরাতন ক্লায়েন্ট রহমান সাহেবের মেয়ের ওয়েডিং প্ল্যানের জন্য সময় বের করতে হয়। আর এখানেই দেখা মেলে নতুন চরিত্র প্রিয়ন্তির। প্রাণচ্ছল ও চঞ্চল প্রকৃতির মেয়েটির পুরো বিয়ের অনুষ্ঠানকে ঘিরে আবর্তিত হয় গল্পের দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত ভাগ। এ অংশটি প্রথম অংশের তুলনায় আরও বিচিত্র এবং হাস্যরসে ভরপুর। সেই সঙ্গে রয়েছে সংগীত বিনোদন, প্রেম ও টুইস্ট।
সায়রা
এই চরিত্রের মাঝে একাধারে রয়েছে একজন পেশাদার ব্যবস্থাপক, প্রতিভাবান শিল্পী, বিষণ্নতা আড়াল করে চলা মানুষ এবং ইতিবাচক মনোরম ব্যক্তি সত্ত্বা। কাহিনির বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিকভাবে এগুলো ফুটিয়ে তোলা যেকোনো নতুন অভিনেত্রীর জন্যই চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু তা মোকাবিলায় বেশ ভালোভাবেই উতরে গেছেন কারিনা। বিশেষ করে মনোলগ, সংলাপহীন বিষণ্নতা ও দুঃখবোধের জায়গাগুলোতে তার অভিব্যক্তিগুলো ছিল প্রশংসনীয়।
গল্পের টুইস্ট ও ক্লাইমেক্স অংশগুলোতেও তার প্রতিক্রিয়াগুলো ছিল যথেষ্ট নিয়ন্ত্রিত এবং পরিমিতিবোধ সম্পন্ন। অবশ্য এখানে দৃশ্যের গতিশীলতার জন্য সম্পাদনা ও পরিচালনাও কৃতিত্বের দাবি রাখে।
স্যাটায়ারের আঙ্গিকে সামাজিক সমস্যা নিরসনের বার্তা
কোথাও স্বল্পতুষ্টির অভাব কোথাও কিছুই না পাওয়ার কষ্ট, প্রেমের সম্পর্কে নিজেকে মেলে ধরতে হীনমন্যতা এবং প্রেমিকের মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী ভাবা। এসব দিয়ে ধীরে ধীরে উপস্থাপন করা হয় উদ্দিষ্ট সমস্যাকে। এরই পরিণতি হিসেবে সম্পূর্ণভাবে ফোকাস করা হয় সায়রার মানসিক আঘাতকে। এটি মূলত বাস্তব সমাজেরই একটি প্রধান সমস্যা। এমন আরও শত শত সায়রা রয়েছে যারা বিষণ্ন জীবন কাটাচ্ছে সমাজের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির যাতাকলে পিষ্ট হয়ে। কেউ কেউ সবকিছু থেকে নিজেকে একদম গুটিয়ে নিচ্ছে, কেউ বা বেছে নিচ্ছে ধ্বংসাত্মক পথ।
কিন্তু এই নেতিবাচক পরিণতি এড়িয়ে সিনেমাটি মার্জিতভাবে পরিবেশন করেছে এ থেকে উত্তরণের পথ। এরই নির্যাস পাওয়া যায় শেষের দিকে প্রিয়ন্তি ও সায়রার মধ্যকার কথোপকথনে।
মূলত নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কারোরই শারীরিক সৌন্দর্য কখনো চিরস্থায়ী নয়। প্রতিটি বস্তুগত চাকচিক্যই সাময়িক এবং তা অচিরেই ক্ষয়যোগ্য। সম্পর্কের বুনিয়াদ যদি সেই সাময়িক সৌন্দর্যের উপর স্থাপিত হয়, তাহলে নিকট ভবিষ্যতে তা নিমেষেই ভেঙে পড়তে বাধ্য।
এর বিপরীতে সম্পর্কের ভিত্তি হওয়া উচিত ভেতরে থাকা মানস সত্ত্বাকে ঘিরে। এই সত্ত্বার মাঝে লালিত হয় ব্যক্তিত্ব ও মানসিকতা, যেগুলো বাহ্যিক অবয়বের মতো মোটেই ঠুনকো নয়। বরং তা চিরকাল ধরে সম্পর্ককে আগলে রাখে শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, ত্যাগ, সততা এবং ভালোবাসার মোড়কে।
শারীরিক সৌন্দর্যের মানদণ্ডে পূর্ণাঙ্গতার বিচার করা যে সংকীর্ণ চিন্তাপ্রসূত এবং সাময়িক, তারই এক উৎকৃষ্ট অভিজ্ঞান ‘৩৬ ২৪ ৩৬’ চলচ্চিত্র। শুধু তাই নয়, যূপকাষ্ঠে বলি হওয়া নারীদের মুক্তির পথও বাতলে দিয়েছে স্যাটায়ারটি। সমাজের প্রতি ঔদ্ধত কটাক্ষ না এনে বরং এক হৃদয়স্পর্শী আন্তরিক আহ্বান রেখেছে কারিনা অভিনীত সায়রা চরিত্রটি। কন্টেন্ট ক্রিয়েটর কারিনার বড় পর্দায় এই অভিষেককে সাদরে গ্রহণ করেছে মুভি প্রেমীরা। উপরন্তু, রম্য ও আবেগসমৃদ্ধ নাট্য-চলচ্চিত্রটি সংলাপ, সংগীত ও হাস্যরস সব মিলিয়ে একটি পরিপূর্ণ নির্মল বিনোদনের প্যাকেজ।