চট্টগ্রামের ‘মাফিয়া’ ব্যবসায়ীকে পার করাতে বিএনপি নেতার ‘ঠিকাদারি’

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০৪:১৩

ছবি: সংগৃহীত
হত্যাসহ অন্তত পাঁচ মামলার আসামি। আবার দেড় হাজার কোটি টাকা ঋণের টাকা আত্মসাৎ। আছে ১৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারে মধ্যস্থতার অভিযোগ। এতকিছুর পরও বিস্ময়করভাবে জামিনে বেরিয়ে গেছেন চট্টগ্রামভিত্তিক ‘মাফিয়া’ ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম সুমন।
চট্টগ্রামে ছাত্রজনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমাতে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগসহ অন্য অঙ্গসংগঠনগুলো যে টাকা খরচ করেছে, তার অর্ধেক টাকাই আওয়ামী লীগঘনিষ্ঠ এই ব্যবসায়ী যোগান দেন বলে অভিযোগ। তার জামিন থেকে শুরু করে নিরাপদে দেশ ছাড়ার পুরো ‘ঠিকাদারি’ নেন চট্টগ্রামে বিএনপির এক তরুণ কেন্দ্রীয় নেতা— যার বিরুদ্ধে গত কয়েক মাসে মামলাবাণিজ্য, পদবাণিজ্য, দখলবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। পাঁচ মাস ধরে পলাতক থাকা সুমন ঢাকা বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামিনে বেরিয়ে এখন সীমান্ত পথে দেশ ছেড়ে পালানোর অপেক্ষায় রয়েছেন। চট্টগ্রাম প্রতিদিনের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল, আওয়ামী যুবলীগ চট্টগ্রাম উত্তর জেলার সভাপতি এসএম রাশেদুল আলম ছাড়াও অনেক বড় বড় নেতা ও সংসদ সদস্যের অর্থপাচারে বিস্ময়কর ভূমিকা রাখেন সাইফুল ইসলাম সুমন।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের ভাই ইউসিবি ব্যাংকের পদচ্যুত পরিচালক আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনির ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও পটিয়া এলাকায় ‘প্রভাবশালী’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন সুমন। ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে সুমন বড় অংকের একটি অনুদানও দেন আওয়ামী লীগকে। এই সুবাদে তিনি অন্তত দুইবার সরাসরি দেখা করেছেন ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান সুমন। তিনি খাতুনগঞ্জভিত্তিক এসএস ট্রেডিং ও শাকিল এন্টারপ্রাইজ নামে দুটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক।
জামিন পেতে ঘাটে ঘাটে টাকা
জানা গেছে, সুমনের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অর্থায়ন ছাড়াও দুটি হত্যা মামলার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকার পরও অবিশ্বাস্য কৌশলে ঘাটে ঘাটে টাকা ঢেলে তিনি প্রথমে ঢাকা বিমানবন্দর হয়ে দেশ ছাড়ার চেষ্টা করেন। প্রভাবশালী বিএনপি নেতার নিবিড় তদারকির পরও রোববার (৫ জানুয়ারি) রাতে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশ সুমনকে নাটকীয়ভাবে গ্রেপ্তার করে।
ঢাকা বিমানবন্দর থানা সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম থেকে তাৎক্ষণিকভাবে সুমনের বিরুদ্ধে হওয়া অন্তত একটি মামলার তথ্য পাওয়ার পরও তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। পরদিন সোমবার (৬ জানুয়ারি) ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের মাধ্যমে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) অস্বাভাবিক গোপনীয়তায় সুমনকে হাজির করানো হয় ঢাকার একটি আদালতে। বিদেশ থেকে কলকাঠি নাড়তে থাকেন চট্টগ্রামে বিএনপির এক তরুণ কেন্দ্রীয় নেতা। তার নির্দেশনায় প্রশাসনের বিভিন্ন মহল থেকে চট্টগ্রামের তিনটি থানার ওসিদের ওপর চাপ তৈরি করা হয়, যেন তারা সুমনের মামলার কোনো ফাইল ঢাকায় না পাঠান অথবা পাঠালেও যেন দেরি করে পাঠানো হয়। চট্টগ্রাম থেকে সদ্য বদলি হওয়া গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তাও সুমনের পক্ষে তৎপর ছিলেন বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
শেষ পর্যন্ত মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অস্বাভাবিক দ্রুততায় ঢাকার একটি আদালত থেকে জামিন পান সুমন। শ্যোন অ্যারেস্টের আবেদন ও সুনির্দিষ্ট মামলার রেফারেন্স থাকার পরও সুমনের জামিন পাওয়ার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্ট একাধিক আইনজীবী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের একজন বলেন, ‘সাইফুল ইসলাম সুমনের জামিনকে কেন্দ্র করে আদালতপাড়ার কোথাও কোথাও ছিল রীতিমতো উৎসবের আমেজ। আমরা শুনেছি, জামিন নেওয়ার প্রতিটি ধাপে থানা থেকে আদালত পর্যন্ত বিভিন্নভাবে সুমনের কাছ থেকে দফায় দফায় টাকা হাতিয়েছেন এক বিএনপি নেতা।’
জানা গেছে, জামিনে বেরুনোর পরপরই সুমন চলে যান অজ্ঞাত স্থানে। এখন তিনি বিমানবন্দর বা সীমান্ত পথ— যে কোনো উপায়ে দেশ ছাড়ার অপেক্ষায় রয়েছেন— সুমনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত একজন এমন তথ্য দিয়েছেন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে।
মামলার ফিরিস্তি
সুমনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে ছাত্রজনতার আন্দোলন চলাকালে সহিংসতা, সহিংসতায় অর্থ যোগানো, পুলিশের ওপর হামলা, চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ, চান্দগাঁও, হাটহাজারীসহ অন্তত পাঁচটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে চান্দগাঁও ও হাটহাজারী থানায় রয়েছে হত্যা মামলা। এছাড়া পটিয়া থানায়ও আছে মামলা। ঋণের নামে ব্যাংকের টাকা মেরে দেওয়ার ঘটনায়ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
তথ্য আটকাতে রহস্যজনক তৎপরতা
গত কয়েকদিন বিভিন্ন সূত্রে খবর নিয়ে জানা গেছে, সুমনের মামলার কোনো ফাইল যথাসময়ে ঢাকায় না পাঠানো কিংবা দেরিতে পাঠানো নিয়ে চলেছে রহস্যজনক তৎপরতা। চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও থানায় সুমনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা থাকার পরও ১০ দিন আগে গত ৫ জানুয়ারি ঢাকায় গ্রেপ্তার হওয়া সুমন সম্পর্কে কোনো তথ্য জানেন না ওই থানার ওসি আফতাব উদ্দিন। তবে তিনি ঢাকায় সুমনের মামলার ‘রিকুইজিশন’ পাঠানোর কথা জানালেও চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধানে জানা গেছে, সুমনের গ্রেপ্তার হওয়ার পরদিন পর্যন্ত ঢাকায় কিছু পৌঁছায়নি। তার আগেই সুমনের জামিন হয়ে যায়।
ওসি আফতাব বলেন, ‘খবর পাওয়ার পর আমরা থানা থেকে কাগজপত্র ঢাকায় পাঠিয়েছি। কিন্তু তার ব্যাপারে বিস্তারিত জানা নেই।’
এ প্রসঙ্গে পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সোলাইমান বলেন, ‘সাইফুল ইসলাম সুমনের বিরুদ্ধে পাঁচলাইশ থানায় একটি মামলা আছে। বিমানবন্দরে সুমন গ্রেপ্তার হওয়ার রিকুইজিশন দেওয়ার পর তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরদিন আমরা তাকে শ্যোন অ্যারেস্ট করি।’
তবে পাঁচলাইশের ওসি মোহাম্মদ সোলাইমানও সুমনের জামিন বা বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে কিছু জানেন না। তিনি বলেন, ‘আমরা খোঁজখবর নিয়ে দেখছি।’
সুমনের বিরুদ্ধে হাটহাজারী মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা থাকলেও ওসি আবু কাওসার মোহাম্মদ হোসেন সেটি বিস্ময়করভাবে মনে করতে পারছিলেন না বুধবার (১৫ জানুয়ারি) সন্ধ্যার ফোনালাপে। তিনি বলেন, ‘আমি ঠিক মনে করতে পারছি না। যেহেতু নাম বলেছেন, আমি খোঁজ নিয়ে দেখবো।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সুমন গ্রেপ্তার হওয়ার পর হাটহাজারী থানা থেকেও ‘রিকুইজিশন’ পাঠানো হয়েছিল ঢাকায়, তবে সেটাও খানিকটা দেরিতে।
অভিযান চালিয়ে ওসিও বেকায়দায়
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় মামলা থাকায় সুমনকে ধরার করার জন্য বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালান চট্টগ্রামের পটিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)। অভিযানের খবর পেয়ে আত্মগোপনে থাকা সুমন বিএনপির এক তরুণ কেন্দ্রীয় নেতার মাধ্যমে পটিয়ার ওসিকে অন্যত্র বদলি করার জন্য তদবির শুরু করেন।
ওই সূত্র দাবি করেছে, বদলির আদেশ কাটাতে সুমনের সঙ্গে আপোষে যেতে বাধ্য হন ওসি। এরপর থেকে ওসি আর সুমনকে ঘাটাতে সাহস করেননি।
আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপির আশ্রয়ে
সুমনের ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাসচারেক আগে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি ইদ্রিস মিয়ার মাধ্যমে চট্টগ্রামে বিএনপির এক তরুণ কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। অবিশ্বাস্য অংকের টাকার বিনিময়ে সুমনকে ‘প্রটেকশন’ দিতে সম্মত হন ওই বিএনপি নেতা। জানা গেছে, ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে সুমনের বিদেশ পালানোর সবরকম ব্যবস্থা করেছিলেন ওই নেতাই, যিনি নিজেও এর দুই দিন আগে বিদেশে যান। চট্টগ্রামের পটিয়ার বাসিন্দা সুমন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সহ–সভাপতি ইদ্রিস মিয়ার ভাইয়ের ছেলে। ইদ্রিস মিয়াকে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতির পদ পাইয়ে দিতে বিএনপির ওই নেতাকে সুমন দেড় কোটি টাকা দেন বলে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার ঝড় ওঠে। তবে এ বিষয়ে নিশ্চিত কিছু জানা যায়নি।